পৃথিবীর মানুষের মাঝে প্রচলিত কোন ধর্মকেই সত্য বা মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করা সমীচীন নয়। বস্তুতঃ সকল ধর্মই সত্য ধর্ম। তবে পৃথিবীর অন্যান্য সকল বিষয়ের মত ধর্মের মাঝেও রয়েছে বিবর্তনের ধারা; আর ধর্মের বিবর্তনের সর্বশেষ অবস্থা হচ্ছে ইসলাম। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব এর পর অদ্যাবধি আর কোন নতুন ধর্মের আবির্ভাব ঘটেনি। আমরা যদি কোন বিশেষ ধর্মের দৃষ্টিতে না তাকিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যাবে যুগে যুগে মানুষের মাঝে একটি ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে কোন একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এক বা একাধিক মানুষের মাধ্যমে। আমরা তাকে নবী/রাসুল কিংবা দেব-দেবী যাই বলি না কেন, তিনি ছিলেন একজন মানুষ। ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস মতে সর্ব প্রথম মানুষ ও নবী হচ্ছেন হযরত আদম(আঃ) এবং সর্বশেষ নবী হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ(সঃ)। তার মানে প্রত্যেক নবীই ছিলেন এক একজন মানুষ তাতে কোন সন্দেহ নেই।

পৃথিবীতে মানুষের গোড়া পত্তনের ইতিহাস বর্তমান সময়ের মানুষের পক্ষে মানব রচিত কোন গ্রন্থের মাধ্যমে জানা সম্ভব নয়। কেননা, সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছে ধাপে ধাপে। আজকের দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই হচ্ছে ভবিষ্যতের ইতিহাস যা পরবর্তী বংশধরদের জানাতে চাইলে ঘটনাগুলোকে গ্রন্থ আকারে রচনা করে সংরক্ষণ করতে হবে। তাহলে হযরত আদম(আঃ) এর সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে কে গ্রন্থ আকারে রচনা করেছে এবং কোথায় সেগুলোকে সংরক্ষণ করা হয়েছে? বর্তমান পৃথিবীর কোন লাইব্রেরীতে কি হযরত আদম(আঃ) এর সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কোন ইতিহাস গ্রস্থ সংরক্ষিত আছে? এ প্রশ্নের উত্তর যারা ধর্মকে স্বীকার করেন না তাদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে ‘না’। কিন্তু যারা ধর্মকে স্বীকার করেন তাদের উত্তর হচ্ছে ‘হ্যা’। কারণ প্রত্যেক ধর্ম বিশ্বাসীরাই কোন না কোন ধর্মীয় গ্রন্থকে তার/তাদের জীবন বিধান বলে বিশ্বাস করেন। যেমন হিন্দুদের ‘বেদ’ খ্রিষ্টানদের ‘বাইবেল’ আর মুসলমানদের রয়েছে ‘কুরআন’। আর পবিত্র কুরআনে হযরত আদম(আঃ) এর জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে পৃথিবীতে বসবাসের বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য যুগের নবী এবং তাদের সময়কালের ঘটনাবলীর বর্ণনাও পবিত্র কুরআনে বিস্তারিত আছে। পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত ঘটনাবলীই প্রমাণ করে এটা কোন মানব রচিত গ্রন্থ নয়। কেননা, কোন মানুষের পক্ষে জানা অসম্ভব অতীতে হযরত আদম(আঃ) বলে কোন মানুষ আদৌ পৃথিবীতে ছিল কি না এবং থাকলে তার জীবন ব্যবস্থা কেমন ছিল। যদি ধরেই নেয়া হয় এগুলো হযরত মুহাম্মদ(সঃ) রচিত কোন কাল্পনিক ঘটনা তাহলে যারা একথা বলেন তাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা “(১) হযরত মুহাম্মদ(সঃ) এর সময় তিনি ব্যতিত আরো কি কেউ ছিলেন কিংবা বর্তমানে আছেন যিনি পবিত্র কুরআনের মত কোন গ্রন্থে এত সুন্দর করে এতগুলো কাল্পনিক ঘটনার অবতারণা করেছেন? (২) কুরআনে উল্লেখিত অনেক বিষয় বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণ সাপেক্ষ এবং কোন কোন বিষয় শতভাগ প্রমাণিত, কল্পনা দ্বারা শতভাগ সত্য প্রতিষ্ঠা করা কি আদৌ সম্ভব?”

পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সুরা ও আয়াতগুলো পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে সমগ্র কুরআনের সর্বত্রই রয়েছে বিজ্ঞানের ছাপ। কুরআনে অনেক জায়গায়ই একের সাথে অন্যের তুলনা উপস্থিত করা হয়েছে। এ তুলনা উপস্থিত করার ব্যাপারে একটি অবিশ্বাস্য মিল অবলম্বন করা হয়েছে এবং তা হচ্ছে সে দু’টি নাম বা বস্তুকে পবিত্র কুরআনে সমান সংখ্যাতেই উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- সুরা আল ইমরানের ৫৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর নিকট ঈসার তুলনা হচ্ছে আদমের মতো’। এখানে স্পষ্টত বুঝা যাচ্ছে মানব জন্মের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এ দু’জন মানুষের জন্ম হয়নি। কেননা, আদম(আঃ) এর জন্ম হয়েছে পিতা-মাতা ছাড়া, অন্যদিকে ঈসা (আঃ) এর জন্ম হয়েছে পিতা ছাড়া। তার থেকেও বড় মিল হচ্ছে, কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আদম নামটি যতবার(২৫ বার) উল্লেখ করা হয়েছে এবং ঈসা নামটিও ততবার(২৫ বার) উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষ সৃষ্টির বিষয়ে কুরআনে যা বর্ণনা করা হয়েছে তা আরো বিষ্ময়কর। পবিত্র কুরআনে ‘ইনসান তথা মানুষ’ শব্দটি ৬৫ বার উল্লেখ করা হয়েছে। আর মানুষ সৃষ্টি সংক্রান্ত সুরা হজ্জ এর ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “আমি তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট ও অপূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট মাংসপিন্ড থেকে, তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্যে। আর আমি এক নির্দিষ্ট কালের জন্যে মাতৃগর্ভে যা ইচ্ছা রেখে দেই, এরপর আমি তোমাদেরকে শিশু অবস্থায় বের করি; তারপর যাতে তোমরা যৌবনে পদার্পণ কর।” এছাড়াও সমগ্র কুরআনের অনেক জায়গায় মানুষের সৃষ্টির প্রক্রিয়া ও তার উপাদানগুলোর বর্ণনা রয়েছে। মানুষ সৃষ্টির প্রথম উপাদান ‘মাটি’ (তোরাব) শব্দটি সমগ্র কুরআনে ১৭ বার, দ্বিতীয় উপাদান ‘শুক্রাণু’ (নুতফা) শব্দটি ১২ বার, তৃতীয় উপাদান ‘রক্তপিন্ড’ (আলাক্ব) শব্দটি ৬ বার, চতুর্থ উপাদান ‘মাংসপিন্ড’ (মোদগা) শব্দটি ৩ বার এবং পঞ্চম উপাদান ‘হাড়’ (এযাম) শব্দটি ১৫ বার উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ উপাদানগুলো যোগ করলে যোগফল হয় ৬৫। কতইনা চমৎকার মিল রয়েছে কুরআনের আয়াতগুলোর মাঝে।

সুরা ‘আরাফ’ এর এক আয়াতে আছে, ‘যারা আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে তাদের উদাহরণ হচ্ছে কুকুরের মত’। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয় যখন দেখি, ‘যারা আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে’ এই বাক্যটি কুরআনে সর্বমোট ৫ বার এসেছে। যেহেতু তাদের উদাহরণ দেয়া হয়েছে কুকুরের সাথে, তাই সমগ্র কুরআনে ‘আল কালব’ তথা কুকুর শব্দটাও এসেছে ৫ বার। এমনিভাবে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, রাত-দিন, আসমান-জমিন, হালাল-হারাম, বেহেস্ত-দোযখ সকল বিষয়ের বর্ণনার ক্ষেত্রে রয়েছে এক অকল্পনীয় মিল। কোন মানুষের পক্ষে কল্পনা করে এত সুন্দর মিল রেখে কোন সাহিত্য রচনা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কুরআন যে মানব রচিত কোন গ্রন্থ নয় এটা অনুধাবন করার জন্য কুরআনের মাঝে বিদ্যমান চমৎকার এই দৃষ্টান্তগুলোই যথেষ্ট। একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তা ব্যতিত কোন মানুষের পক্ষে কি মানব সৃষ্টির প্রাথমিক ইতিহাস জানা সম্ভব? পবিত্র কুরআনে মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে ইসলাম ধর্মের বিস্তার লাভ এর সময়কাল পর্যন্ত যে সকল ঘটনাবলীর অবতারণা করা হয়েছে তা কেবলমাত্র কোন মানুষের কল্পনার দ্বারা রচনা করা সম্ভব নয়। সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, পবিত্র কুরআন কেবল মানুষের জীবন বিধানই নয় বরং মানুষের জন্য মহান আল্লাহ তা আলা নিজেই একটি ঐতিহাসিক দলিল তথা ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করে দিয়েছেন মানুষকে তার অতীত সম্পর্কে জানানোর জন্য।

এবার আসা যাক অন্যান্য ধর্মের বিষয়ে। একটা বিষয় স্পষ্ট যে, যুগে যুগে ধর্ম বিবর্তিত হয়েছে কোন একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যার সর্বশেষ অবস্থা হচ্ছে আজকের ইসলাম ধর্ম। আর পবিত্র কুরআনেও এ বিষয়টির উল্লেখ আছে। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন আল্লাহ তা আলা বিভিন্ন সময়ে নবীগণের মাধ্যমে মানুষের কাছে হেদায়েতের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। আর এসকল বার্তা যে কেতাবে রক্ষিত ছিল/আছে সেটাই হচ্ছে আসমানী কিতাব বা ঐশি গ্রন্থ। অসংখ্য আসমানী কিতাবের মধ্যে মুসলমানগণ সর্বশেষ ৪টি আসমানী কিতাব এর বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকে যথা- তাওরাত, যাবুর, ঈঞ্জিল ও কুরআন। আর এই ৪টি কিতাবের অনুসারীগণ কম-বেশী আজও পৃথিবীতে টিকে আছে। পবিত্র কুরআনে ইসলামের আবির্ভাব এর পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবীতে বহু জাতির উত্থান ও পতনের ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সেই সকল জাতির উপর অর্পিত ঐশি গ্রন্থের মধ্যে কেবলমাত্র তাওরাত, যাবুর ও ঈঞ্জিল ব্যতিত অন্যকোন ঐশি গ্রন্থের অস্তিত্ব বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে আছে কি না তা সুস্পষ্ট নয়। যেমন- পৃথিবীতে অসংখ্য ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সনাতন ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা তৃতীয় অবস্থানে হলেও তারা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ বেদ, গীতা কিংবা পুরানকে ঐশি গ্রন্থ বলে দাবী করেন না। অন্যদিকে ইসলাম ধর্মের অনুসারীগণ অসংখ্য ঐশি গ্রন্থের ব্যাপারে বিশ্বাস করলেও সেখানে বেদ, গীতা কিংবা পুরান এর কোন স্থান নেই। যাইহোক বেদ, গীতা কিংবা পুরান ঐশি গ্রন্থ কি না সে ব্যাপারে আমি বিতর্কে যেতে চাই না, তবে পৃথিবীতে মানুষের আগমন এবং বিস্তার লাভ ঘটেছে ধাপে ধাপে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার কোন সুযোগ নেই, তা সে যৌক্তিক, বৈজ্ঞানিক কিংবা ধর্মীয় যেদিক থেকেই বিচার করা হোক না কেন। আর সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে মানুষ পাঠিয়েছেন বসবাস করার জন্য আর তাদেরকে কোন গাইডলাইন প্রদান করেননি এটিও একটি হাস্যকর ব্যাপার। তার অর্থ এটাই দাঁড়ালো যে, যুগে যুগে সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য মানুষের জন্য গাইডলাইন প্রদান করেছেন যা সময়ের সাথে বিবর্তিত আকারে প্রকাশ পেয়েছে, ঠিক যেমন- একটি রাষ্ট্র সময়ের সাথে সাথে তাদের পরিচালনা নীতি তথা সংবিধান পরির্তন, সংযোজন-বিয়োজন তথা পরিমার্জন করে থাকেন। এটা বলতে দ্বিধা নেই যে সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক মানুষের জন্য রচিত ঐ গাইডলাইনই হচ্ছে ঐশি গ্রন্থ যার সর্বশেষ রূপ হচ্ছে পবিত্র কুরআন।

কোন রাষ্ট্রের সংবিধান নতুনভাবে সংস্কার করার পর যেমন পূর্ববর্তী সংস্করণ মিথ্যা হয়ে যায় না বরং রহিত হয়ে যায়, ঐশি গ্রন্থের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। আর বাস্তবতা হচ্ছে ঐশি গ্রন্থের নতুন সংস্করণ আসার পরে কেউ কেউ তা মেনে নিলেও অনেকেই তার বিরোধীতা করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে অসংখ্য ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে। সুতরাং পৃথিবীর মানুষের মাঝে প্রচলিত কোন ধর্মই মিথ্যা নয়। পৃথিবীর সকল ধর্মই মানুষকে মানবিকতা ও ন্যায় পরায়নতার শিক্ষা দেয়। কিন্তু মানুষ যদি ধর্মের মূল নীতিকে উপেক্ষা করে নিজেদের মনগড়া মতবাদ সৃষ্টি ও তার পূঁজারী হয় তাহলে সেটা তো ধর্মের দোষ নয়। অতীতে ঐশি গ্রন্থগুলো বিকৃত করে মানুষ নিজেদের খেয়ালখুশি মত ব্যবহার করেছে বলেই যুগে যুগে ঐশি গ্রন্থগুলোর মাঝে বিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। যেহেতু কুরআন হচ্ছে ঐশি গ্রন্থগুলোর মধ্যে বিবর্তনের সর্বশেষ অবস্থা এবং কুরআনের পর ঐশি গ্রন্থের আর কোন নতুন সংস্করণ আসেনি তাই পবিত্র কুরআনকে জীবন বিধান হিসেবে মেনে নিয়ে নিজেকে পরিচালিত করাই একজন বুদ্ধিমান মানুষের কাজ।

আমরা অনেক সময় ভুল করি, প্রকৃতপক্ষে কুরআন কেবলমাত্র মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ নয় বরং এটি মহান সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত গোটা মানব জাতির জন্য একটি পথ নির্দেশিকা। অর্থাৎ কুরআন শুধুমাত্র মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ নয় বরং যারা কুরআনের আলোকে জীবন পরিচালনা করেন তারাই মুসলমান। বস্তুতঃ কোন ঐশি গ্রন্থই কোন বিশেষ ধর্মের অনুসারীদের ব্যক্তিগত/সমষ্টিগত সম্পত্তি নয় বরং যেকেউই যেকোন ঐশি গ্রন্থ অধ্যায়ন করে তার মর্মানুসারে জীবন পরিচালনার অধিকার রাখেন। তবে যেহেতু ঐশি গ্রন্থ বিবর্তনশীল তাই সর্বশেষ সংস্করণ অনুসরণ করে নিজেকে পরিচালনা করাটাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।

পবিত্র কুরআনকে ঐশি গ্রন্থ বলে স্বীকার করার অর্থই হচ্ছে কুরআনে বর্ণিত বিষয় ও ঘটনাগুলোকে সত্য বলে স্বীকার করে নেয়া। যারা কুরআনকে ঐশি গ্রন্থ বলে স্বীকার করেন, হযরত আদম(আঃ) ও বিবি হাওয়া(আঃ) যে সর্ব প্রথম মানব ও মানবী এ ব্যাপারে তাদের দ্বিমত থাকার কোন কারণ নেই। আর যারা কুরআনকে ঐশি গ্রন্থ বলে স্বীকার করেন না, তারা খুঁজে দেখার চেষ্টা করতেই পারেন, কে পৃথিবীর সর্বপ্রথম মানব ও মানবী। যাইহোক, পৃথিবীতে মানব বসতির প্রারম্ভিক অবস্থা আর আজকের আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা যে কোনভাবেই এক নয় তা অনুধাবন করার জন্য বড় বড় ডিগ্রী গ্রহণের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না।

পৃথিবীতে মানব বসতির শুরুতে ছিল মাত্র দু’জন মানুষ এবং শুধু তাইই নয় বরং মহান আল্লাহ কর্তৃক পূর্ণাঙ্গরূপে সৃষ্ট দু’জন মানুষ। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, “তিনিই সে সত্তা যিনি তোমাদিগকে সৃষ্টি করেছেন একটি মাত্র সত্তা থেকে; আর তার থেকেই তৈরী করেছেন তার জোড়া, যাতে তার কাছে স্বস্তি পেতে পারে। অতঃপর পুরুষ যখন নারীকে আবৃত করল, তখন, সে গর্ভবতী হল। অতি হালকা গর্ভ। সে তাই নিয়ে চলাফেরা করতে থাকল। তারপর যখন বোঝা হয়ে গেল, তখন উভয়েই আল্লাহকে ডাকল যিনি তাদের পালনকর্তা যে, তুমি যদি আমাদিগকে সুস্থ ও ভাল দান কর তবে আমরা তোমার শুকরিয়া আদায় করব(আল আরাফ/১৮৯)।” অর্থাৎ আল্লাহ তা আলা মাটি দিয়ে হযরত আদম(আঃ) কে তৈরী করার পর তার থেকেই তার সঙ্গীনি হিসেবে বিবি হাওয়া(আঃ) কে তৈরী করেন। তারপর তাদের উভয়ের ঔরসে জন্ম হতে থাকে জোড়ায় জোড়ায় সন্তান বিবর্তনের ধারায় যা পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানের অবস্থায় এসেছে। তো যাইহোক, আজকের যুগে আমরা জন্মের পর বড় হওয়ার সাথে সাখে যেসকল বিষয়ের সাথে পরিচিত হতে থাকি পৃথিবীতে মানব বসতির প্রারম্ভে সেগুলো কল্পনা করারও কোন প্রশ্ন আসেনা। কেননা, কেবলমাত্র দু’জন মানুষ, না তাদের ঘর-বাড়ী, টাকা-পয়সার চাহিদা ছিল, না ছিল বিলাসিতার কোন আবশ্যকতা। এটা স্পষ্ট যে, তারা বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত, ক্ষুধা লাগলে বিভিন্ন ফল-ফলাদি খেয়ে নিত, আর বিশ্রামের প্রয়োজনে আশ্রয় নিত কোন গুহায়। আর যখনি কোন সমস্যায় পতিত হতেন সরাসরি সাহায্য চাইতেন মহান আল্লাহর নিকট; বলা যায় আল্লাহর সাথে ছিল তাদের ছিল সরাসরি যোগাযোগ।

কালের পরিক্রমায় দু’জন মানুষ থেকে সৃষ্টি হয়েছে অনেক মানুষ যাদেরকে মহান আল্লাহ তা আলা সরাসরি নির্দেশনা দিয়ে পরিচালিত করেছেন। অর্থাৎ মহান স্রষ্টা হযরত আদম(আঃ) এবং তার বংশধরদের সকলের মাঝে কম-বেীশ দৈব শক্তি দিয়ে তাদের পৃথিবীর বুকে অভিযোজনের সুযোগ দিয়েছিলেন একথা নিঃসন্দেহে অনুমান করা যায়। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, “আর আল্লাহ তা’আলা শিখালেন আদমকে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীর নাম। তারপর সে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীকে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্য হয়ে থাক। তারা বলল, তুমি পবিত্র! আমরা কোন কিছুই জানি না, তবে তুমি যা আমাদিগকে শিখিয়েছ(সেগুলো ব্যতীত) নিশ্চয় তুমিই প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন, হেকমতওয়ালা। তিনি বললেন, হে আদম, ফেরেশতাদেরকে বলে দাও এসবের নাম। তারপর যখন তিনি বলে দিলেন সে সবের নাম, তখন তিনি বললেন, …………….। অতঃপর হযরত আদম (আঃ) স্বীয় পালনকর্তার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শিখে নিলেন, অতঃপর আল্লাহ পাক তাঁর প্রতি(করুণাভরে) লক্ষ্য করলেন। নিশ্চয়ই তিনি মহা-ক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালু(বাকারা/৩১-৩৭)।” পবিত্র কুরআনের এই আয়াতগুলো থেকে এটা পরিষ্কার যে আল্লাহ তা আলা আদম(আঃ) কে সরাসরি নির্দেশনা এবং বেশকিছু অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আদম(আঃ) এর বংশধর তথা সন্তানদের মাঝেও যে তার প্রভাব ছিল এটা অস্বীকার কোন সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। আদম(আঃ) এর পর আল্লাহ তা আলা যাদেরকে নবী ও রাসুল হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন, তাদের প্রত্যেককেই দিয়েছিলেন বিশেষ কিছু ক্ষমতা বা মোজেজা। পবিত্র কুরআনের মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি, হযরত মুসা(আঃ) তার হাতের লাঠির আঘাতে লোহিত সাগরের পানিকে বিভক্ত করে বনি ইসরাইলিদের জন্য রাস্তা তৈরি করেছিলেন এবং পাথর খণ্ডের মধ্যে আঘাত করে বনি ইসরাইলের বারটি গোত্রের জন্য বারটি ঝর্ণা প্রবাহিত করেছিলেন। আবার হযরত ঈসা(আঃ) এর স্পর্শে মৃত মানুষ জীবিত হতো, অন্ধ মানুষ দৃষ্টি ফিরে পেত, বোবা মানুষ বাকশক্তি ফিরে পেত, কুষ্ঠরোগ আরোগ্য হতো এমনকি তিনি মাটি দিয়ে পাখি তৈরি করার পর তাতে প্রাণ সঞ্চারিত করতেন।

আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরীত সকল নবীগণের মাঝেই ছিল কিছু অলৌকিক ক্ষমতা। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ(সঃ) কে মহান আল্লাহ তা আলা যেসকল অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছিলেন তার মধ্যে সব থেকে বড় হচ্ছে পবিত্র কুরআন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ(সঃ) দুনিয়ার কোন মানুষের কাছ থেকে অক্ষরজ্ঞান অর্জন করেননি, অথচ মহান আল্লাহ তাঁর অন্তরে ৩০ পারা কুরআন ধারণ করে দিয়েছেন, এটাই হচ্ছে নবীগণের বিশেষ ক্ষমতার একটা চরম দৃষ্টান্ত। বর্তমান আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগেও অনেক মানুষ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ বিশেষ ক্ষমতা পেয়ে থাকেন, যে ক্ষমতা বলে তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে সমাজ, রাষ্ট্র বা বিশ্বের দরবারে। কেউবা খোঁজার চেষ্টা করছে মহান আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য; আর কেউবা মানব কল্যাণের নিমিত্তে মেতে আছে আবিষ্কারের নেশায়। সাধারণ মানুষের দ্বারা প্রকাশিত এই জ্ঞান কোন মোজেজা নয়, কিন্তু এটা যে মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ জ্ঞান যা তিনি পেয়েছেন, অথচ অন্য কেউ পায়নি, এটা স্বীকার না করাটা অজ্ঞতা।

বর্তমান সময়ের একটি আলোচিত নাম, ‘সুবর্ণ আইজ্যাক বারী(জন্মঃ ৯ এপ্রিল ২০১২ খ্রিঃ)’ মাত্র ৬ বছর বয়সে গণিত, পদার্থ এবং রসায়নে যে পারদর্শীতা দেখিয়েছেন বা দেখাচ্ছেন, এটা কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব। আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় সুবর্ণকে ২০১৮ সালে একজন বিজ্ঞানী এবং ২০২০ সালে একজন অধ্যাপক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যে বয়সে অন্যান্য শিশুরা কার্টুন কিংবা ভিডিও গেমস নিয়ে মেতে থাকে, সে বয়সে সুবর্ণ পিএইচডি স্তরের গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের সমস্যাগুলো সমাধান করতে সক্ষম। গণিত, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞানে নিজ দক্ষতার পাশাপাশি নিজের লেখা ‘দ্য লাভ’ গ্রন্থ ও সন্ত্রাসবিরোধী ক্যাম্পেইনের কারণে বিস্ময় বালক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে সুবর্ণ। বিস্ময় বালক ‘সুবর্ণ’ এর জ্ঞান যে স্বয়ং স্রষ্টা কর্তৃক প্রদত্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একথা ঠিক যে, পৃথিবীর সকল মানুষের জ্ঞানই স্রষ্টা প্রদত্ত, কিন্তু ‘সুবর্ণ’ এর জ্ঞান আর সকল মানুষের জ্ঞান যে এক নয়, তা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না।

পশু বা পাখি যেমন বাচ্চা জন্ম দেয়ার পর তাদের দেখভাল করে, ভালোবাসে, ক্ষুধার সময় বাচ্চার মুখে অন্ন যোগান দেয়, বিপদের সময় তাদের আগলে রাখে অতঃপর প্রাপ্ত বয়স হওয়ার সাথে সাথে পাখি সাবকটি উবলব্ধি করে এখন থেকে নিজেকেই তার নিজের খাবার সংস্থান করতে হবে, বিপদের সময় নিজেকে নিজেই রক্ষা করতে হবে; হযরত আদম(আঃ) এর সন্তানদের অবস্থাও ঠিক তেমনি ছিল। বংশবৃদ্ধির সাথে সাথে হযরত আদম(আঃ) এর সন্তানেরা যে যার মত করে যত্র তত্র ছড়িযে ছিটিয়ে পড়ে বসতি স্থাপন ও বংশবিস্তার করেছে, এটাই স্বাভাবিক। পবিত্র কুরআন এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি আল্লাহ মানুষ ছাড়াও জ্বিন এবং ফেরেশতা তৈরী করেছেন কিন্ত তারা মানুষের দৃষ্টিশক্তির বাইরে। মানুষ জ্বিন ও ফেরেশতাদের দেখতে পায় না অথচ তারা আছে। তবে যারা ঐশি বাণী স্বীকার করেন তারা বিশ্বাস করেন আল্লাহ তা আলা মানুষের মাঝে ঐশি বাণী পৌঁছে দিয়েছেন ফেরেশতার মাধ্যমে। অর্থাৎ নবীগণ যখনই কোন সাহায্যের প্রয়োজন মনে করে আল্লাহকে স্মরণ করতেন, তখনই আল্লাহ ফেরেশতা পাঠিয়ে তার সমাধান জানিয়ে দিতেন। একইভাবে হযরত আদম(আঃ) এর সন্তানেরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপনের পর বিভিন্ন সময় কোন সমস্যায় পতিত হলে নিশ্চয় তারাও আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন এবং তাদের সমস্যার সমাধানও মহান আল্লাহ তা আলা ফেরেশতার মাধ্যমেই দিয়েছেন।

কালের পরিক্রমায় প্রত্যেক গোষ্ঠীর বয়জ্যোষ্ঠরা হয়ে ওঠেন একেকজন নেতা কিংবা কোন কোন ধর্মের অনুসারীদের কাছে দেবতার মত। যদিও পবিত্র কুরআনে দেবতার বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট বিষয় উল্লেখ নাই, তবুও পৃথিবীর বুকে অনেক ধর্মাবলম্বীগণ বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ বহু দেবতায় বিশ্বাস করেন। প্রকৃতপক্ষে তারা যাদেরকে দেবতা বলে বিশ্বাস করেন তাদের অস্তিত্ব বর্তমানে পৃথিবীতে নেই। হতে পারে তারা সৃষ্টির আদিলগ্নে যেসকল মানুষ দৈবশক্তির অধিকারী ছিলেন তাদেরকেই দেবতা বলে সম্মোধন করে তাদের পূঁজা-অর্চনা করে থাকেন। এমনটি হলে এসকল দেব-দেবীর পূঁজা-অর্চনা করার পিছনে কী যুক্তি আছে তা তারাই ভালো জানবেন। তবে কোন দেব-দেবী এই বিশ্বভ্রমান্ডের স্রষ্টা নন বরং এই বিশ্বভ্রমান্ড সৃষ্টির পিছনে রয়েছে এক মহাশক্তি যাকে আল্লাহ/ঈশ্বর/ব্রহ্মা/গড যাই বলিনা কেন তিনি এক ও অদ্বিতীয়। কেবলমাত্র পবিত্র কুরআনেই নয় বরং ‘আল্লাহ’, ‘মোহাম্মদ’ ও ‘রাসূল’ তিনটি আরবী শব্দযোগে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ অলোপনিষদে যে শ্লোকটি লিখিত হয়েছে তা হলো-

“হোতার মিন্দ্রো হোতার মিন্দ্রো মহাসূরিন্দ্রাঃ

অল্লো জ্যেষ্টং শ্রেষ্ঠং পরমং ব্রহ্মণং অল্লাম॥

অল্লো রসূল মোহাম্মদ রকং বরস্য অল্লো অল্লাম।

আদাল্লাং বুকমেকং অল্লাবুকং লিখর্তকম।”

যার বাংলা অর্থঃ দেবতাদের রাজা আল্লাহ আদি ও সকলের বড় ইন্দ্রের গুরু। আল্লাহ পূর্ণ ব্রহ্মা, মোহাম্মদ আল্লাহর রাসূল পরম বরণীয়, আল্লাহ আল্লাহ। তাঁর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই। আল্লাহ অক্ষয়, অব্যয়, স্বয়ম্ভু।

এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক একজন এবং কেবলমাত্র একজনই, এটা বিভিন্ন ঐশি গ্রন্থ যেমন সমর্থন করে, তেমনি যৌক্তিক বিচারেও এটাই প্রতীয়মান হয়। তা না হলে বিশ্বভ্রমান্ডের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ যুগ যুগ ধরে একই নিয়মে পরিচালিত হতো না বা হতে পারতো না। তবে মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক একজন হলেও মহাবিশ্বের বিভিন্ন কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য রয়েছে স্রষ্টা কর্তৃক নিযুক্ত এক বিশাল বাহিনী তাতে সন্দেহ করার কোন অবকাশ নাই। কুরআনের ভাষায়, “আমি জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাই রেখেছি। আমি কাফেরদেরকে পরীক্ষা করার জন্যেই তার এই সংখ্যা করেছি ………… । আপনার পালনকর্তার বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন এটা তো মানুষের জন্যে উপদেশ বৈ নয়(সূরা মুদ্দাচ্ছির/৩১)।” পবিত্র কুরআন থেকেই আমরা জানতে পারি, পৃথিবীর বিভিন্ন কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য আল্লাহ তা আলা অসংখ্য ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছে- জিব্রাইল(আঃ), মিকাঈল(আঃ), আজরাইল(আঃ), ইসরাফিল(আঃ), কেরামুন, কাতিবুন ইত্যাদি। তবে অসংখ্য ফেরেশতাদের যে বাহিনী রয়েছে তারা নিজে থেকে কিছু করার ক্ষমতা রাখে না বরং তারা কেবলমাত্র তাদের সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ মান্য করে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ইসলাম ধর্মে ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা অন্যতম একটি ঈমানী দায়িত্ব কিন্তু আল্লাহ ব্যতিত ফেরেশতা বা অন্য কারো উপাসনা করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ বা হারাম। অন্যদিকে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীরা বহু দেবতায় বিশ্বাস করেন, যেমন- ব্রহ্মা স্রষ্টা, বিষ্ণু সংরক্ষণকারী, শিব ধ্বংসকারী, শুভ সূচনা এবং সুখের দেবতা গণেশ, হনুমান অষ্ট সিদ্ধি, কার্তিকেয় যুদ্ধের দেবতা, খবরের দেবতা নারদ, বিশ্বকর্মা স্থাপত্যের দেবতা, ধনবন্তরী চিকিৎসক ও আয়ুর্বেদের দেবতা, আকাশের দেবতা ডায়াস, পানির দেবতা বরুণ, অগ্নি দেবতা অগ্নি, সমুদ্র দেবতা সমুদ্র, বারিয়াদেব রোগের দেবতা, চিত্রদেব শিল্পের দেবতা ইত্যাদি। তাদের এসকল দেবতা দ্বারা পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত ফেরেশতাদের বুঝিয়েছেন কি না, তা তারাই ভালো বলতে পারবেন।

ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস মতে বৃষ্টি বর্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা হচ্ছেন ‘মিকাঈল(আঃ)’ অন্যদিকে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করেন পানির দেবতা হচ্ছেন ‘বরুণ’। এক্ষেত্রে যদি সনাতম ধর্মে বিশ্বাসীগণ ইসলাম ধর্মে বর্ণিত ‘মিকাঈল(আঃ)’ ফেরেশতাকে তাদের পানির দেবতা ‘বরুণ’ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন তাহলে বিশ্বাসের ক্ষেত্রটা কিন্তু একইরূপ দাঁড়ায়; পার্থক্য কেবল উপাসনার ক্ষেত্রে। মুসলমানরা ‘মিকাঈল(আঃ)’ ফেরেশতার উপাসনা করেন না, কারণ তারা বিশ্বাস করেন ফেরেশতাগণ কেবলমাত্র আল্লাহর নির্দেশ পালন করেন, তাই উপাসনা পাওয়ার যোগ্য শুধুমাত্র মহান আল্লাহ, কোন ফেরেশতা নন। পক্ষান্তরে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীরা ‘বরুণ’ দেবতার উপাসনা করেন। কারণ তারা বিশ্বাস করেন দেবতারা ঈশ্বরের কর্তৃত্ব ও কাজ-কর্মে অংশীদার হিসেবে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ফেরেশতা বা দেবতা কাউকেই মানুষ তার চর্ম চক্ষু দ্বারা দেখতে পায় না অথচ ‍মুসলমানগণ ফেরেশতা বিশ্বাস করেন আর সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীগণ দেবতায় বিশ্বাসের পাশাপাশি তাদের কাল্পনিক মূর্তি তৈরী করে তার পূঁজা/উপাসনা করে থাকেন।

ধর্মের মূল শিক্ষা কী? পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মের মূল বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সকল ধর্মের মূল বাণী হচ্ছে, “নিজে ভালো থাকো, অন্যের অনিষ্ট করবে না এবং স্রষ্টার আরাধনা করো।” অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষেরই পৃথিবীতে স্বাধীন ভাবে বাঁচার অধিকার সমান। একজন মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেরই উচিৎ নিজে ভালো থাকার জন্য চেষ্টা করা, অন্যদের ক্ষতি না করে বরং সাধ্যমত তাদের ভালো করার চেষ্টা করা এবং সুস্থভাবে সকল কাজ সম্পাদনের জন্য স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা। আর এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যেসকল ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে সেসব ধর্মের সবগুলোই সত্য। এখন যদি কেউ ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি কিংবা বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত থাকে কিংবা এক আল্লাহ/ঈশ্বরের পরিবর্তে বহু ঈশরের পূঁজা করে কিংবা আল্লাহ/ঈশ্বরের শরীক হিসেবে বহু দেবতার পূঁজা করে কিংবা বিমূর্ত আল্লাহ/ঈশ্বরের মূর্ত প্রতিক বা মূর্তি বানিয়ে উপাসনা করে সেটা তার/তাদের অজ্ঞতা কিংবা খামখেয়ালী, ধর্মের দোষ নয়। সনাতন ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’ এর অনেক স্থানে হযরত মুহাম্মদ(সঃ) এর আগমণের বিষয়ে উল্লেখ আছে, ঠিক যেমন উল্লেখ আছে কুরআন এর পূর্ববর্তী ঐশি গ্রন্থ ঈঞ্জিল কেতাবে। শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে সনাতন ধর্মগ্রন্থ বেদে নবী মোহাম্মদ(সঃ) সম্পর্কে যতগুলো ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে, তা আর অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থে এতটা করা হয়নি।

সনাতন ধর্ম মতে, পৃথিবীতে যখন ধর্মের পরাজয় হয়, অধর্ম অন্যায় ও অত্যাচার যখন জগৎ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়, তখনই অবতার ধরাধামে আগমন করেন এ পৃথিবীকে পাপমুক্ত করার জন্য। সনাতনধর্মীয় শাস্ত্রমতে যুগ চারটি, যথা- সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি। পূর্বের যুগে যেভাবে অবতার এসেছিলেন, তেমনি কলিযুগেও একজন ‘কল্কি অবতার’ বা ‘অন্তিম অবতার’ আগমনের বিস্তারিত আলোচনা সনাতন ধর্মগ্রন্থে বিদ্যমান। উল্লেখ্য যে, অবতার অর্থ: অবতীর্ণ, প্রেরিত, বার্তা বাহক যার আরবী প্রতিশব্দ হলো, নবী, রাসূল বা “নাবিয়্যুন”। আর কলি মানে শেষ যার আরবি প্রতিশব্দ হলো “খাতামুন”। এবার দু’টি শব্দকে একত্রিত করলে “খাতামুন নাবিয়্যুন” বা শেষ নবী হবে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, “মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী (আল-আহযাব/৪০)।” সনাতন ধর্মগ্রন্থ মতে, কল্কি অবতারের নাম ‘নরাশংস’। বাংলা অর্থঃ প্রসংশিত এর আরবী প্রতিশব্দ “মুহাম্মাদ”। ‘নর’ অর্থ পুরুষ এবং ‘আশংস’ অর্থ প্রশংসিত। বেদে বলা হয়েছে, “নরাশংসং সুধৃষ্টযমপশ্যং সপ্রথস্তমং(ঋকবেদ ১/১৮/৯)।” সামবেদে আছে,

“মদৌ বর্তিতা দেবাদকারান্তে প্রকৃত্তিতা।

বৃষাণাংভক্ষয়েৎ সদামেদা শাস্ত্রে চ স্মৃতা”।

অর্থাৎ যে দেবের নামের প্রথম অক্ষর ‘ম’ এবং শেষ অক্ষর ‘দ’ হবে এবং যিনি গরুর মাংস ভক্ষণ করাকে সর্বকালের জন্য বৈধ ঘোষণা করবেন, তিনিই হবেন বেদানুযায়ী শেষ ঋষি তথা কল্কি অবতার। এখানে পরিষ্কার যে, ‘মুহাম্মাদ’ নামের প্রথম অক্ষর ‘ম’ এবং শেষ অক্ষর ‘দ’ আর তিনিই গরুর মাংস খাওয়াকে কিয়ামত পর্যন্ত বৈধ ঘোষণা করেছেন।

সনাতন ধর্মগ্রন্থে অন্তিম অবতারের আগমন, জন্ম বৃত্তান্ত, বড় হওয়া থেকে শুরু করে জীবদ্দশায় তিনি কেমন গুণের অধিকারী হবেন তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে এবং সবগুলো গুণ সর্ব শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ(সঃ) এর সাথে সম্পূর্ণরূপে মিলে যায়। সুতরাং সনাতন ধর্মের বাণীই প্রমাণ করে হযরত মুহাম্মদ(সঃ) শেষ অবতার বা শেষ নবী এবং তাঁকে মান্য করা শাস্ত্রেরই নির্দেশ। তাহলে হযরত মুহাম্মদ(সঃ) এর আগমনের পর আর ‘বেদ’ বা ‘ঈঞ্জিল’ কিংবা অন্যকোন ঐশি কেতাব অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা না করে বরং কুরআনের আলোকে জীবন পরিচালনা করাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত, কেননা ঐ কেতাবগুলোই সাক্ষ্য দিচ্ছে কুরআন হচ্ছে স্রষ্টার পক্ষ থেকে প্রচারিত ঐশি বাণী আর হযরত মুহাম্মদ(সঃ) হচ্ছেন তার বার্তা বাহক বা নবী। সনাতম ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’ এর আরো একটি উল্লেখযোগ্য শ্লোক হচ্ছে-

“লা-ইলাহা হরতি পাপম ইল্ইলাহা পরম পাদম,

জন্ম বৈকুণ্ঠ অপ ইনুতি ত জপি নাম মুহাম্মদ।”

অর্থাৎ লা-ইলাহার আশ্রয় ছাড়া পাপ মুক্তির কোনো প্রকৃত আশ্রয় নাই। বৈকুণ্ঠে জন্ম লাভের আশা করিলে ইলাহর আশ্রয় নেয়া ছাড়া কোনো গতি নাই। আর এ জন্য মুহাম্মদ এর প্রদর্শিত পথের অনুসরণ ও অনুকরণ একান্তই অপরিহার্য।

ধর্মকে যদি কেবলমাত্র পরজগতের মুক্তির গাইডলাইন হিসেবে বিচেনা করা হয়, তাহলে কোন ধর্ম অনুসরণ করলে পরজগতে কার, কী পরিণতি হবে তা কেবলমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। কিন্তু যদি ধর্মকে ইহজগতে মুক্তির গাইডলাইন হিসেবে বিচেনা করা হয় তাহলে যেকোন একটি ধর্ম সঠিকভাবে অনুসরণ করাই যথেষ্ট। আর যদি ধর্মকে ইহজগত ও পরজগত উভয় জগতে মুক্তির সোপান হিসেবে বিচেনা করা হয়, তাহলে ঐশি ধর্ম সঠিকভাবে অনুসরণ করার কোন বিকল্প নেই। ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাসের ব্যাপার, আপন স্বার্থের উর্দ্ধে উঠে মানব কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারলে কোন ধর্ম মানা বা না মানায় কী আসে যায়? কোন ধর্ম মানা বা না মানা যেকোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত অধিকার, কিন্তু কোন ধর্মকে কিংবা কোন ধর্মের অনুসারীদেরকে তিরষ্কার/উপহাস করা সম্পূর্ণরূপে মানব ধর্মের পরিপন্থী। ধর্ম মানুষের জন্য, মানুষ ধর্মের জন্য নয়, কাজেই নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে কোন ধর্মই তাকে মুক্তির পথ দেখাতে পারবে না।

মোঃ আব্দুল হাই খান
পরিচালক
গাইবান্ধা কম্পিউটার এন্ড আইটি এডুকেশন।
E-mail: haikhan2002@gmail.com

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *