কায়িক পরিশ্রম করে বিনিময়ে যে অর্থ নেয়া হয় তা হলো মজুরী। ডাক্তার রোগী দেখে প্রেসক্রিপশন দিয়ে টাকা(ফি) নেন, শিক্ষক শিক্ষার্থী পড়িয়ে টাকা(বেতন) নেন, ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি গ্রাহকের হাতের নাগালে পৌঁছে দিযে টাকা(মুনাফা) নেন, ইমাম/মোয়াজ্জিন পাঁচবার নামাজ পড়ানো, আযান দেয়া, মসজিদ রক্ষণাবেক্ষনের বিনিময়ে টাকা(সম্মানী/হাদিয়া) নেন ইত্যাদি ইত্যাদি ……… প্রকৃতপক্ষে এগুলো সবই সেবা যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন পক্ষকে বেকায়দায় ফেলে এগুলো নেয়া হয়। ডাক্তার যদি কোন রোগীকে বেকায়দায় ফেলে কিংবা অযথা হয়রানীর মাধ্যমে বেশী মাত্রায় ফি নেন; শিক্ষক যদি শিক্ষাদানকে ব্যবসায় পরিনত করেন; ব্যবসায়ী যদি গ্রাহককে বেকায়দায় ফেলে অধিকতর মুনাফা লুটে নেন; ঈমাম/মোয়াজ্জিন যদি তাদের বিকল্প নাই তাই অস্বাভাবিক সম্মানী দাবী করেন; তবে তা সেবা হতে পারে না বরং এটা জুলুম।

একজন ব্যবসায়ী কম মূল্যে পণ্য কিনে বেশী মূল্যে বিক্রি করে মুনাফা নেন কারণ তিনি সেবা দিচ্ছেন। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান ঐ ব্যবসায়ীকে ব্যবসা করার জন্য মূলধন সরবরাহ করে অর্জিত আয় থেকে কিস্তির মাধ্যমে অল্প অল্প করে পরিশোধ করার সুযোগ দিয়ে তাকে মূলধনের মালিক হতে সাহায্য করছেন, সেই প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ীকে কী দিচ্ছেন? ব্যবসা করার জন্য একযোগে মোটাদাগে টাকা(মূলধন) দেয়া, অর্জিত আয় থেকে কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেয়া, কিস্তির টাকা নিজস্ব লোক দ্বারা আদায় করে ব্যবসায়ীর সময় ও বাড়তি খরচ বাঁচানো, নিয়মিত কিস্তি পরিশোধে বাধ্য করে তাকে দ্রুত মূলধনের মালিক হতে সাহায্য করা, এগুলো যদি সেবা না হয় তাহলে এগুলো কী?

  1. কোন ব্যবসায়ী প্রয়োজনে অন্যের নিকট থেকে মূলধন সংগ্রহ করতেই পারেন, কিন্তু ব্যবসায় মূলধন সরবরাহ করে যদি তার ব্যবসায় নাক গলাতে চান তিনি তা কখনোই চাইবেন না।
  2. ব্যবসার মূলধন খোয়া না গেলে ব্যবসায় লাভ না হলেও(আয়-ব্যয় সমান) লোকসান হয়েছে বলার সুযোগ নেই।
  3. লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে কারো কাছ থেকে মূলধন নিয়ে ব্যবসা করে বছর শেষে যদি আয়-ব্যয় সমান হয় তাহলে আসল টাকা ফেরৎ দিলে ব্যবসায়ীর কিছুই থাকবে না।
  4. যদি মূলধন খোয়া না যায় এবং কিস্তিতে অর্জিত আয় থেকে গৃহীত মূলধন ফেরৎ প্রদানের সুযোগ এবং চাপ থাকে তাহলে ব্যবসায়ী চাইবেন অন্যান্য খরচ কমিয়ে দিয়ে হলেও নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করে দ্রুত গৃহীত মূলধনের মালিক হতে।
  5. কিস্তিতে গৃহীত মূলধন পরিশোধের শর্তে ঋণ নিয়ে ঋণের বিপরীতে যে অতিরিক্ত অর্থ(চার্জ) দেয়া হয় তা সারা বছরের অর্জিত মুনাফার তুলনায় একেবারেই নগন্য। অন্যদিকে অর্জিত আয় থেকে কিস্তি পরিশোধের সুযোগ থাকায় বছর শেষে গৃহীত মূলধন পুরোটাই ব্যবসায়ীর নিজের হয়ে যাবে; এমনকি ভাগ্য ভাল হলে এক বছরে ঐ মুলধন বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বা আরো বেশী হতে পারে।
  6. সুদ সেটাই যেটা ঋণ দিয়ে তার বিপরীতে মাসে মাসে মোটা অংকের লাভ(সুদ) নেয়া হয় কিংবা চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেয়ে পাহাড়সম হতে থাকে। ঋণ দেয়ার পর তা পরিশোধের সুযোগ না দিয়ে তার জন্য মাসে মাসে লাভ(সুদ) উত্তোলন করলে গৃহীত ঋণের টাকা কখনোই পরিশোধ হয় না; যতক্ষণ পর্যন্ত না ঋণ দাতাকে গৃহীত টাকা একযোগে ফেরৎ প্রদান করা হয়।
  7. একজন ব্যবসায়ীকে ঋণ হিসেবে মূলধন সরবরাহ করা, অর্জিত আয় থেকে কিস্তির মাধ্যমে গৃহীত ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেয়া, বছর শেষে ঋণের টাকায় ব্যবসায়ীকে মূলধন গঠনে সহায়তা করা, বছর বছর মূলধন বৃদ্ধিতে সহায়তা করা নিঃসন্দেহে একটি সেবা। সেবার বিনিময়ে যে অর্থ নেয়া হয় তা সুদ হতে পারে না বরং এটা হচ্ছে সার্ভিস চার্জ বা সেবার বিনিময়ে গৃহীত অর্থ।
  8. নারী-পুরুষের দৈহিক সম্পর্ককে কখনো বলা হয় বৈধ, কখনো বলা হয় জেনা আর কখনো বলা হয় ধর্ষণ। প্রথম ক্ষেত্রে, উভয়ে সম্মত ছিল এবং বিষয়টা অন্যান্যরাও জানে; দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, উভয়ে সম্মত ছিল কিন্তু বিষয়টা অন্যান্যরা জানে না; আর তৃতীয়টা হয় জোড়পূর্বক। একই ধরণের নারী-পুরুষের সম্পর্ক যেমন স্থান-কাল-পাত্র ভেদে একেক রকম ঠিক তেমনি একই অর্থ বিনিয়োগের ধরণের উপর ভিত্তি করে কখনো হয় তা মুনাফা, কখনো হয় সুদ আর কখনো হয় সার্ভিস চার্জ।
  9. ব্যবসা বৈধ এই যুক্তিতে কেউ যদি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ১০ টাকায় ক্রয় করা দ্রব্য ৯০ টাকা লাভ ধরে ১০০ টাকায় বিক্রি করেন, আর ঐ দ্রব্য অন্যজন ১০০ টাকায় কিনে ১০ টাকা লাভ ধরে ১১০ টাকা বিক্রি করেন; আর এ দু’জনের ব্যবসাকেই যদি বৈধ বলা হয় তাহলে ডিকশেনারীতে লিপিবদ্ধ সুদ, ঘুষ, জুলুম, চুরি, ডাকাতি, অবৈধ শব্দেগুলো সম্পূর্ণ অর্থহীন শব্দ।
  10. কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ১০ টাকায় কেনা পন্য ১০০ টাকায় বিক্রি করা এবং ঐ পন্য অন্যজনের ক্ষেত্রে ১০০ টাকায় কিনে ১১০ টাকা বিক্রি করা যেমন এক হতে পারে না, ঠিক তেমনি ঋণ দিয়ে ঋণ পরিশোধের সুযোগ না দিয়ে মাসে মাসে লাভ(সুদ) নেয়া আর ঋণ দিয়ে অর্জিত আয় থেকে কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিয়ে বছর শেষে ঋণ গ্রহীতাকে গৃহীত ঋণের টাকায় মূলধন গঠনে সহায়তা করা কখনোই এক হতে পারে না।

সুদ কখনোই কোন সমাজের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না্, তা সে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাই চালু থাক কিংবা অন্যকোন সমাজ ব্যবস্থা। যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর তা সবসময়ই পরিত্যাজ্য। কিন্তু ধর্মীয় গোড়ামীর কারণে কেউ যদি নিজের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে সুদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, তাহলে সেটাও কোন সমাজের জন্য কাম্য নয়।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *