সাম্প্রতিককালে পবিত্র কোরআনের সুরা কাফিরুন এর শেষ আয়াতটির অনুবাদ করে নিজেকে একজন কোরআন বিশেষজ্ঞ বলে জাহির করার চেষ্টা করে চলেছেন অনেকেই। আমার তো মনে হয় নিজের মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে তারা নিজের অজান্তে অথবা স্বেচ্ছায় ফেতনা সৃষ্টির সুযোগই করে দিচ্ছেন। অথচ পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ২১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “ধর্মের ব্যাপারে ফেতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহা পাপ।।”
পবিত্র কোরআনের কোন আয়াত বা সুরা ব্যাখ্যা করতে হলে উক্ত আয়াত বা সুরা নাযিলের প্রেক্ষাপট বা শানে নযুল বিবেচনা করা একান্ত আবশ্যক। সুরা কাফিরুন এর শানে নযুল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাসূল(সাঃ) যখন মক্কায় তাওহীদের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন, তখন মক্কার কুরাইশগণ নানা কৌশলে তাঁকে এই দাওয়াত দেয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। সকল প্রকার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা এক নতুন কৌশল অবলম্বন করে তাওহীদের দাওয়াত ও কুফরীর মধ্যে একটা আপোস-মীমাংসার প্রস্তাব হিসেবে কুরাইশদের কাফের সম্প্রদায় রাসূলুল্লাহ্(সাঃ) কে আহবান জানান যে, তিনি এক বছর তাদের মূর্তির পূজা করবেন, আর তারাও এক বছর তাঁর মা’বূদ আল্লাহর ইবাদত করবে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা এই সূরাটি নাযিল এর মাধ্যমে তাঁর রাসূল(সাঃ) কে আদেশ করেন(হে নবী), ১) বলুনঃ হে কাফের সম্প্রদায়! ২) তোমরা যার ইবাদত কর আমি তার ইবাদত করি না। ৩) তোমরাও ইবাদতকারী নও যার আমি ইবাদত করি। ৪) আর আমি ইবাদতকারী নই তোমরা যার ইবাদত কর। ৫) তোমরা ইবাদতকারী নও যার আমি ইবাদত করি। ৬) তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য আমার দ্বীন আমার জন্য।
কেউ কেউ এ সুরার প্রথমের আয়াতগুলোকে উপেক্ষা করে শেষ আয়াতটিকে অধিকতর ফোকাস করার চেষ্টা করে থাকেন, যার উদাহরণ ড্যাটা ছাড়া ছাতার মত। ছাতার ড্যাটা বাদ দিলে যেমন ছাতার কোন অস্তিত্ব থাকে না, তেমনি কোন আয়াত বা সুরা নাযিলের প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে কেবলমাত্র কোন বিশেষ অংশ উদ্ধৃত করে ব্যাখ্যা করলে প্রকৃত সত্য উপলুব্ধ হয় না। সুরা কাফিরুন এর শেষ আয়াত থেকে এটিই স্পষ্ট যে, ইসলাম ধর্মের সাথে অন্যকোন ধর্মের কোন আপোষ নেই। অথচ সুরা কাফিরুন এর শেষ আয়াত এর অনুবাদে অনেকে বলে থাকেন, তোমার ধর্মও ঠিক, আমার ধর্মও ঠিক।
আমি ইতোপূর্বে একটি পোস্ট এর শিরোনাম দিয়েছিলাম “পৃথিবীর কোন ধর্মই মিথ্যা নয়”। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, পৃথিবীর যেকোন ধর্ম অনুসরণ করলেই মানুষ মুক্তি পেয়ে গেল। অবশ্য যারা পরকালে বিশ্বাস রাখেন, একথা কেবল তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর যারা পরকালে বিশ্বাস করেন না তাদের ক্ষেত্রে কোন ধর্ম মানা বা না মানা দু’টোই সমান কথা।
পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা বল, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের প্রতি এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তদীয় বংশধরের প্রতি এবং মূসা, ঈসা, অন্যান্য নবীকে পালনকর্তার পক্ষ থেকে যা দান করা হয়েছে, তৎসমুদয়ের উপর।” এখন কোরআনের এই আয়াতের ভিত্তিতে যদি বলা হয়, যেহেতু মুসা(আঃ) এর উপর নাজিলকৃত তাওরাত এবং ঈসা (আঃ) এর উপর নাযিলকৃত ঈঞ্জিল উভয়ই ঐশি গ্রন্থ এবং তারা প্রত্যেকেই নবী/রাসুল ছিলেন সুতরাং কোরআন ছেড়ে তাওরাত বা ঈঞ্জিল অনুসরণ করলে ক্ষতি কী? তাহলে তা হবে কোন দেশের সংবিধান কিংবা আইন পরিবর্তন পরিমার্জন করার পর তা উপেক্ষা করে পূর্ববর্তী সংবিধান বা আইন অনুসরণ করার মত।
সুরা মায়িদার ৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” একই সুরার ৪৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “আমি তোমাদের প্রত্যেককে একটি আইন ও পথ দিয়েছি। যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তোমাদের সবাইকে এক উম্মত করে দিতেন, কিন্তু এরূপ করেননি-যাতে তোমাদেরকে যে ধর্ম দিয়েছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা নেন।”
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, একমাত্র ‘ইসলাম ধর্মই’ মহান আল্লাহর নিকট মনোনীত ধর্ম এবং মহান আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য সক্ষমতা থাকা স্বত্ত্বেও পৃথিবী থেকে অন্যান্য ধর্মের বিলুপ্তি ঘটাননি। ইসলাম ব্যতিত অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের পরিণতি কী হবে তার বর্ণনাসহ কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা আলা রাসুল(সাঃ) কে ধর্মের ব্যাপারে জবরদস্তি করতে নিষেধ করেছেন। সুরা বাকারার ২৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই।” পবিত্র হাদিসের মাধ্যমেও মহানবী(সাঃ) ধর্ম নিরপেক্ষতার শিক্ষাই দিয়েছেন। কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে যদি কেউ ‘অন্য ধর্ম পালনে বাধা সৃষ্টি না করা’ না বুঝে বরং ‘সকল ধর্মকে হৃদয়ে ধারণ ও লালন করা’ বুঝাতে চান সেটা নিশ্চয় তার অজ্ঞতা।
কোরআন না বুঝার কারণে যারা সুরা কাফিরুন এর শেষ আয়াতের অনুবাদে ‘তোমার ধর্মও ঠিক, আমার ধর্মও ঠিক’ বলে থাকেন কিংবা ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ বলে মনগড়া স্লোগান দেন, সেটা আর যাইহোক, রাষ্ট্রীয় স্লোগান হতে পারে না। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে কোন রাষ্ট্রে সকল ধর্মের অনুসারীদের স্ব স্ব ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের সুযোগ দেয়া, কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অন্য ধর্মের অনুসারীদের অংশগ্রহণ করা বা করার সুযোগ দেয়া নয়। বস্তুতঃ ধর্ম যার, উৎসবও তার, কেননা প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীরাই নিজ নিজ আচার-অনুষ্ঠান তথা উৎসবের মাধ্যমে আপন ধর্মকে প্রস্ফুটিত করে তোলে। কাজেই ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এরূপ উক্তি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অবাস্তব। এটা কখনোই কোন রাষ্ট্রের স্লোগান হতে পারে না বরং ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ এটাই রাষ্ট্রের স্লোগান হওয়া যুক্তিসঙ্গত এবং গ্রহণযোগ্য।