বহু বছর ধরে আমরা আমাদের ঘুনে ধরা, পচন ধরা রাজনীতির যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে আসছি। স্বাধীনতার ৫৩-তম বছরে অর্থাৎ ২০২৪ সালে এসে আমাদের তরুণ প্রজন্ম বুঝিয়ে দিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে ক্রমাগতভাবে এমনটি চলতে দেয়া যায় না। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণ অভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এবং ২০০৬ সালে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের পতন, কোথায় নেই শিক্ষার্থীদের ভূমিকা? কিন্তু আমাদের তথাকথিত রাজনীতিবিদরা এটা স্বীকার করলেও বাস্তবে তারা বরাবরই এর বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। আর ফলশ্রুতিতে জনগণ তাদেরকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। ২০২৪ সালে একটি স্বাধীন দেশে যেন শুরু হয়েছে আর একটি স্বাধীনতা যুদ্ধ, রচিত হচ্ছে এক নতুন ইতিহাস। এরুপ অবস্থায় আমাদের তথাকথিত রাজনীতিবিদদের বোধদয় না হলেও ৭১ সালে যারা দেশটাকে স্বাধীন করার জন্য অকাতরে নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিয়েছিল, আমার মনে হয় আজ তারা কবরে শুয়ে শুয়ে বর্তমান অবস্থা দেখে লজ্জিত হচ্ছেন আর আক্ষেপ করছেন, এজন্যই বুঝি আমরা পরাধীন দেশটাকে স্বাধীন করার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিলাম?

অনেক দেরী করে ফেলেছি আমরা। রাজনীতিতে আমুল পরিবর্তন এখন সময়ের দাবী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরণের শাসন ব্যবস্থা বলবৎ থাকলেও যেকোন প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাধারণত দু’ধরণের শাসন ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়। এক- সংসদীয় সরকার, যেখানে শাসন বিভাগ আইন বিভাগের উপর নির্ভরশীল ও সংসদের কাছে দায়ী থাকে এবং দুই- রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার, যেখানে শাসন বিভাগ আইন বিভাগের নিকট দায়ী বা তার উপর নির্ভরশীল থাকে না। এখানে রাষ্ট্রপতি তার মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে সরাসরি দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেন। কিন্তু এগুলো হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা, বাস্তবতা হচ্ছে বহুজনের লুটে-পুটে খাওয়ার সুযোগ আছে এধরণের সরকারকে বলা হয় “সংসদীয় সরকার” আর কেবলমাত্র একজনের লুটে-পুটে খাওয়ার সুযোগ আছে একে বলে “রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার”।

বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে সামরিক সরকারের পতনের পর থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সরকারকে বলা হয় গণতান্ত্রিক সরকার। সংসদীয় সরকার এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার উভয় ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেভাবে পঁচন ধরেছে তাতে উল্লেখিত কোন ধরণের শাসন ব্যবস্থাই বাংলাদশে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারছে না। বস্তুতঃ ঘুনে ধরা, পঁচন ধরা রাজনীতির মাঝে যে ধরণের সরকার ব্যবস্থাই চালু থাক না কেন, তা কখনোই জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে না। কাজেই এদেশের রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে রাজনীতির মাঝে একটা আমুল পরিবর্তন আনা জরুরী হয়ে পড়েছে। এই আমুল পরিবর্তনের লক্ষ্যে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি নজর দেয়া খুবই জরুরী।

১। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে অচল। যেখানে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় শাসকগণকে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থাকার কথা সেখানে দলীয়ভাবে সকলে মিলে লুটপাটের মহোৎসবে জড়িয়ে পড়েন। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার অভিলাসে তারা জনগণের দারস্থ হওয়ার পরিবর্তে সরকারী টাকায় তথা জনগণের অর্থে পোষেন লাঠিয়াল বাহিনী, গুন্ডা বাহিনী আর ক্যাডার বাহিনী। একবার কোনভাবে মুচলেকা দিয়ে জনগণের হাতে-পায়ে ধরে ক্ষমতায় আসতে পারলেই ব্যাস, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে চলে নানা টালবাহানা। যদিও সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় কেবিনেট বা মন্ত্রীসভা জনগণের আশা-আকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থ হলে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংসদ ও মন্ত্রীসভা গঠনের সুযোগ আছে কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি অকল্পনীয়, যদিনা মন্ত্রী পরিষদ মাইনক্যার চিপায় পড়ে। আর এটা আমরা ২০০৬ সালে যেমন দেখেছি, তেমনি দেখছি ২০২৪ সালে এসে। মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থায় বিরোধী দল সরাসরি সরকারের সমালোচনা করতে পারে বিধায় ক্ষমতাসীনরা তাদের ক্ষমতার নীল নকশা এমনভাবে তৈরী করেন যে পরবর্তী নির্বাচনে যাতে কোন বিরোধী পক্ষই তৈরী হতে না পারে সেটা পাকাপোক্ত করা হয় অর্থাৎ কায়েম করা হয় এক দলীয় শাসন এবং লুটপাটের রাজনীতি। জাতীয় স্বার্থ অপেক্ষা দলীয় সদস্য/কর্মীদের সন্তুষ্টির বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে বছর বছর বাজেট এর আকার বৃদ্ধি করে জাতীয় অর্থের অপচয় করা হয়।

পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা ক্ষমতা পৃথকীকরণ ও ভারসাম্যের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে এখানে স্বৈরাচারিতার সুযোগ কম থাকে। যেকোন জরুরী পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি কারও সাথে পরামর্শ না করেই দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন বলে যেকোন সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবেলা করা তুলনামূলকভাবে সহজ। কেবলমাত্র দলীয় বিবেচনা নয় বরং রাষ্ট্রপতি যেকোন যোগ্য লোককে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন বলে মন্ত্রীত্ব হারানোর ভয়ে কোন মন্ত্রীর পক্ষেই দূর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া সহজ হয় না। অর্থাৎ, স্বয়ং রাষ্ট্রপতি লুটপাটের সাথে জড়িত না হলে মন্ত্রী পরিষদের পক্ষে এটা একেবারেই অসম্ভব। আর রাষ্ট্রপতি যদি দূর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন তাহলে জনগণের পক্ষে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা তুলনামূলকভাবে সহজ। আর সব থেকে বড় ব্যাপার হচ্ছে, এই ব্যবস্থায় জাতীয় অর্থের অপচয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সুতরাং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরকে এখনি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় ফিরে আসা উচিৎ।

২। সংবিধানে এমন শর্ত আরোপ করা উচিৎ যেখানে একই ব্যক্তি দুইবারের অধিক রাষ্ট্রপতি/ প্রধান মন্ত্রী/ সরকার প্রধান হতে পারবেন না।

৩। ৭০ বছরের অধিক বয়সীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ থাকলেও নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ থাকবে না।

৪। কমপক্ষে স্নাতক ডিগ্রীধারী না হলে ইউপি/উপজেলা/জেলা/পার্লামেন্ট কোন নির্বাচনেই প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার সুযোগ থাকবে না।

৫। একজন সত্যিকারের রাজনীতিবিদ হতে হলে তাকে অবশ্যই প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। কেননা, সংবিধান, রাষ্ট্রীয় আইন, বৈদেশিক নীতি এগুলো সম্পর্কে ভালো জ্ঞান না থাকলে রাজনীতিতে জোড়ালো ভূমিকা রাখা অসম্ভব। আর পড়াশোনা না করে এই জ্ঞান কখনোই অর্জিত হয় না। তাই যে সকল রাজনীতিবিদ পড়াশোনার পরিবর্তে ক্যাডার বাহিনী গড়ে প্রকাশ্যে পেশী শক্তির মহড়া প্রদর্শন করে থাকেন, সংবিধান অনুযায়ী তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

৬। কোন রাজনৈতিক দলের ভিতরে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে ঐ দল জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। উল্লেখ্য, আমাদের বর্তমান ঘুনে ধরা রাজনীতিতে দলীয় কর্মীরা কোনভাবেই নেতার বিরোধীতা করতে পারে না। অবস্থা এমন যে নেতা যদি বলেন আগামীকাল সূর্য্য পশ্চিম দিকে উঠবে তাতেও অধিনস্তরা দ্বি-মত পোষণ করেন না। কারণ আমাদের ঘুনে ধরা রাজনীতির শিক্ষাই হচ্ছে ”বস ইজ অলওয়েজ রাইট”; যদি এটা মানতে না পারো তাহলে দল থেকে আউট। দলের ভিতরে যদি মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকে তাহলে সে দল ক্ষমতায় গেলে তো স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই গড়ে তুলবে, এটাই বাস্তবতা।

৭। মন্ত্রী পরিষদ গঠনের ক্ষেত্রে বাধ্যতা মূলকভাবে গোটা মন্ত্রীসভার অন্ততঃ এক তৃতীয়াংশ মন্ত্রী বিরোধী দল থেকে নিয়োগ করতে হবে।

৮। কোন সরকার রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন মূলক কোন কাজ শুরু করার পরে তা শেষ করার আগেই যদি ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে তাহলে পরবর্তী সরকার যাতে খামখেয়ালী বশতঃ চলমান প্রকল্প বাতিল করে দিয়ে জাতীয় অর্থের অপচয় করার দুঃসাহস দেখাতে না পারে সেটা সংবিধান দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে।

৯। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সরকারী হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার সহ সকল সরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারী যেকোন রাজনৈতিক মতাদর্শ লালন করতেই পারেন; কিন্তু প্রকাশ্যে এমনটি দাবী করলে সংবিধান অনুযায়ী তিনি সরকারী চাকুরী করার নৈতিক অধিকার হারাবেন এবং চাকুরী থেকে বরখাস্ত হবেন।

১০। গনতন্ত্রের চর্চা এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতিবিদ তৈরীর লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একাধিক মতাদর্শের ছাত্র সংগঠন থাকতে পারবে কিন্তু তারা কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে দাবী করতে পারবে না বা কোন রাজনৈতিক দলও ওদেরকে তাদের অঙ্গ সংগঠন বলে দাবী করতে পারবে না। এমনটি করা হলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র সংগঠন উভয়ই সংবিধান অনুযায়ী তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর নৈতিকতা হারাবে।

১১। রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব হ্রাস করার লক্ষ্যে প্রতি বছর সরকারী বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত চাকুরীজীবিদের মধ্য থেকে সিস্টেমেটিকভাবে অন্ততঃ ২৫% চাকুরীজীবিকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসর প্রদান করে নতুনদেরকে নিয়োগ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

আমি এখানে গুটি কয়েক বিষয়ে পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেছি; কিন্তু এগুলোই যথেষ্ট নয়। একটু নিবিড়ভাবে চিন্তাভাবনা করলে আরও অনেক বিষয় খুঁজে পাওয়া যাবে যেগুলোতে পরিবর্তন আনয়ন করা জরুরী। তাই দেশের বুদ্ধিজীবি এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞদের উচিৎ, উল্লেখিত বিষয়গুলো সহ আরো কী কী বিষয় আছে যেগুলো কোন রাষ্ট্র প্রধানকে স্বৈরাচারী হওয়ার প্রণোদনা যোগায় সেগুলো চিহ্নিত করে যার যার অবস্থান থেকে মতামত উপস্থাপন করা। পাশাপাশি বিদ্যমান সরকারের উচিৎ হবে বিশেষজ্ঞদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

সব শেষে বলবো, প্রজাতন্ত্রের মালিক যদি জনগণ হয় তাহলে জনগণের স্বার্থে কোন নির্বাচিত সরকার যাতে কোনভাবেই স্বৈরাচারী সরকারে পরিণত হওয়ার সুযোগ না পায় সেটা সংবিধান দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে সংবিধানের স্বার্থে রাষ্ট্র নয় বরং রাষ্ট্র তথা জনগণের স্বার্থে সংবিধান। এটা কোন ঐশী বাণী নয় যে, সংবিধানের দোহাই দিয়ে একটি সরকার স্বৈরাচীর আচরণ করবে, এটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

লেখকঃ মোঃ আব্দুল হাই খান
ই-মেইলঃ haikhan2002@yahoo.com
তারিখঃ ০৩/০৮/২০২৪

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *