বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সব থেকে নিকৃষ্ট দিক হচ্ছে দূর্বল ভিত্তির ওপর বহুতল ভবন নির্মাণের বৃথা চেষ্টা। প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। কোন ভবনের ভিত্তি মজবুত না করে একটি সুরম্য বহুতল ভবন নির্মাণের চেষ্টা করা যেমন অবাস্তব; ঠিক তেমনিভাবে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি মজবুত না করে বছর বছর কেবলমাত্র সনদপত্র নির্ভর উচ্চশিক্ষিত পয়দা করা দেশের জন্য জঞ্জাল ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। সম্ভবত বাংলাদেশ ভিন্ন পৃথিবীতে আর একটি দেশও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে প্রাথমিক শিক্ষার থেকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয় উচ্চ শিক্ষাকে। অথচ প্রত্যেক শিশুর ভবিষ্যৎ শিক্ষা জীবনের বীজ রোপিত হয় প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে।

বিশ্বের যেসকল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সেরা হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফিনল্যান্ড। ফিনল্যান্ডকে বলা হয় পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে সুখী দেশ। ফিনল্যান্ডে ৭ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তির কোন সুযোগই নেই। এ দেশে ৭ থেকে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত চলে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম। ফিনল্যান্ডের ছেলেমেয়েরা হাই স্কুলে পড়াশোনা করে ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত। ১৬ বছরের আগে ফিনল্যান্ডের ছেলে-মেয়েদের উপর কোন প্রকার পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় না। শিক্ষকদের কাজ হচ্ছে পুরো সময়টা জুরে শিক্ষার্থীদের ভেতরের প্রতিভা খুঁজে বেড় করা। কোন শিক্ষার্থী কী পড়বে আর কী পড়বে না সেটা সম্পূর্ণ নির্ধারিত হয় শিক্ষার্থীদের পছন্দ অনুযায়ী। হোম ওয়ার্ক বা বাড়ীর কাজ বলতে ফিনল্যান্ডে কোন কিছূ নেই। বরং শিক্ষার্থীরা যাতে আনন্দের সাথে পড়াশোনা করতে পারে সেদিকে বিশেষ নজর রাখা হয়।

ফিনল্যান্ডে সবচাইতে সম্মানের এবং উচ্চ বেতনের চাকরি গুলোর মধ্যে শিক্ষকতা রয়েছে প্রথম সারিতে। কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা সেরা গ্র্যাজুয়েটরাই এখানে শিক্ষকতা করার সুয়োগ পেয়ে থাকেন। তবে শুধুমাত্র পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলেই এখানে শিক্ষক হওয়া যায় না। এখানে শিক্ষক হতে আগ্রহীদেরকে এক দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে শিক্ষক হওয়ার জন্য উপযুক্ত বলে নির্বাচিতদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ পান সব থেকে সেরাগণ। ফিনল্যান্ডে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় পাঠদানের কৌশলের উপর। যিনি যত বেশি আনন্দের মাধ্যমে শিশুদেরকে পাঠদানে সক্ষম তিনি তত বেশি যোগ্য বলে বিবেচিত হন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করার পর প্রস্তুতকৃত তালিকা থেকে ১০০ জনের মধ্যে প্রথম ১০/১৫ জনকে নির্বাচন করা হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে। অবশিষ্ট তালিকা থেকে প্রথমে হাই স্কুল এরপর কলেজের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। সব শেষে যারা অবশিষ্ট থাকেন তারা সুযোগ পান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার। আর বাংলাদেশে সম্পূর্ণ এর উল্টো চিত্র।

বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা সব থেকে বেশি অবহেলিত। এদেশে যেসকল মাস্টার্স ডিগ্রীধারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন তারা মূলতঃ অন্য কোথাও সুযোগ পাননি বলেই এখানে রয়ে গেছেন। প্রথমতঃ এদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করাটাকে সম্মানজনক বলে বিবেচনা করা হয় না। দ্বিতীয়তঃ শিক্ষক হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন এবং পদমর্যাদা সব থেকে কম। অথচ জাতীয় স্বার্থে সব থেকে বেশি বেতনে সব থেকে অধিক যোগ্যদেরকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়াটা সব থেকে বেশি জরুরী ছিল। কেননা, আজকের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরাই আগামীদিনের নাগরিক/সুনাগরিক। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শিক্ষকের পদমর্যাদা ও বেতন কাঠামো সমান হওয়া উচিৎ। আর যদি পদমর্যাদা ও বেতনের পার্থক্য করতেই হয় তাহলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদমর্যাদা ও বেতন সব থেকে বেশি হওয়া উচিৎ। প্রাথমিক স্তরে যেসকল শিক্ষার্থীর ভিত মজবুত তারাই পরবর্তীতে হাই স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করে থাকে। একথা অনস্বীকার্য যে,  সকল শিক্ষার্থীর শিক্ষার ভিত রচিত হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং যার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় হাই স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুতরাং জাতিকে উন্নত করতে হলে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া অত্যাবশ্যক।

এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘাঁ। এক দিকে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা অবহেলিত, অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের নোট-গাইড জাতিকে ধ্বংস করার জন্য এক নিরব মাইন হিসেবে কাজ করে চলেছে অবিরত। যেখানে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্য বইগুলো অধ্যায়নের মাধ্যমে একটি শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটার কথা সেখানে তারা নোট-গাইড আর পরীক্ষা পরীক্ষা করতে করতে ‘মানসিক বিকাশ’শব্দটির সাথেই পরিচিত হতে পারছে না। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, প্রাথমিক স্তরের ইংরেজী বইগুলো কথপোকথনের দৃশ্য দ্বারা ভরপুর হলেও প্রাথমিক বিদ্যালয় পাশ করার পর ইংরেজীতে কথা বলা তো দূরে থাক শিক্ষা জীবন শেষ করার পরও ইংরেজীতে কথা বলার দক্ষতা অর্জনের জন্য করতে হয় TOEFL/IELTS কিংবা অন্যকোন ইংলিশ স্পোকেন কোর্স। কিছূ ব্যতিক্রম ছাড়া এ দেশের মাস্টার্স সম্পন্ন করা অধিকাংশ ছেলে-মেয়েই ইংরেজীতে কথা বলা তো পরের কথা, গুছিয়ে কিছূ লিখতে বললেও তাদের প্যালপিটিশন শুরু হয়ে যায়।

পৃথিবী গতিশীল, পৃথিবীর নিয়ম-কানুনও গতিশীল। তাই মান্ধাতা আমলের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেড় হওয়া এখন সময়ের দাবী। আসুন সকলে মিলে একই সুরে বলি, “প্রথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শিক্ষকের বেতন ও পদমর্যাদা সমান হোক। বিশ্বিবিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় আসুক। উন্নত দেশ ও উন্নত জাতি গঠনে এটাই হোক আমাদের অভিপ্রায়।”

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *