যে নামাজ ইহলৌ্কিক জীবনে কল্যাণ আনয়ন করতে পারে না, সে নামাজ কখনোই বেহেস্তের চাবি হতে পারে না। “নামাজ বেহেস্তের চাবি”- ইসলামী চিন্তাবিদগণ এটাকে ঠিক এমনভাবে প্রচার করে থাকেন যেন নিয়মিত নামাজ আদায় করলেই পরকালে নিশ্চিত তিনি বেহেস্তে যাবেন। অন্যদিকে যারা নামাজ আদায় করেন না তারা কখনোই বেহেস্তে যাবেন না। নামাজ সম্পর্কে পবিত্র কোরাণে ৮২ বার তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, একমাত্র নামাজ এর মাধ্যমেই আল্লাহ-তা-আলার নিকটবর্তী হওয়া সম্ভব। নবীজির ভাষায়, “আস্‌সালাতু মিরাজুল মুমিনিন” অর্থাৎ সালাত বা নামাজ মুমিনদের মিরাজ। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়, মহানবী (সাঃ) মিরাজের মাধ্যমে আল্লাহ-তা-আলার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন, মুমিন বান্দাগণও ঠিক তেমনিভাবে নামাজ এর মাধ্যমে আল্লাহ-তা-আলার সান্নিধ্য লাভ করতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই নামাজ এখন ‘রাকাত’ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ অর্থাৎ যে ব্যক্তি যত বেশী ‘রাকাত’ নামাজ আদায় করবে তার বেহেস্তের চাবি তত মজবুত হবে। আজকাল তো এমনও দেখা যায়, রমজান মাসে মসজিদে ২০ রাকাত তারাবী শেষে জামায়াতে বেতরের নামাজ আদায়ের পর অনেকেই তরিঘরি করে দু’রাকাত নফল নামাজের নিয়ত করেন, ফলে যারা নফল আদায় করেন না তাদেরকে হয় বসে অপেক্ষা করতে হয়, নয়তো অন্যজনের নামাজ এর সামনে দিয়ে যেতে হয়। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় নফল নামাজ আদায় তো নয়, যেন নামাজ এর নাম করে অন্যের পথ আগলে রাখেন।

দুনিয়ার কর্ম যার ভালো হবে, আখেরাতে তিনিই সফলকাম হবেন। তাহলে বেহেস্তের চাবি খোঁজার কী দরকার? নবীজির ভাষায়, “আদ-দুনইয়াউ মাজরাতুল আখিরাহ” অর্থাৎ ‘এ দুনিয়া হলো আখিরাতের বাজার’। যদি তাই হয় তাহলে বেহেস্ত লাভ এর আশায় নামাজ কেন? মহান আল্লাহ-তা-আলা বেহেস্তের চাবি হিসেবে নামাজকে প্রেরণ করনেননি বরং নামাজ হচ্ছে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের একটি সহজ মাধ্যম। কোন মুমিন যখন কোন সমস্যায় পতিত হবেন, তখনি তিনি দু’রাকাত নামাজ আদায় করে আল্লাহর নিকট সাহায্য চাইবেন এবং দয়াময় আল্লাহ তা গ্রহণ করতে কখনোই কুন্ঠাবোধ করেন না। আর এটাই হচ্ছে নামাজ এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা মহানবী (সাঃ) ও তার সাহাবীগণ করতেন এবং পৃথিবীর বুকে আজও অনেক মুমিন এটাই করে থাকেন, তবে সংখ্যায় খুবই নগণ্য।

বেহেস্তের চাবি মনে করে নামাজ আদায় করলে ঐ চাবি কখনোই বেহেস্তের দরজা খুলতে কাজে আসবে না, যদি না ঐ নামাজ দ্বারা দুনিয়ার কোন সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয়। নামাজ সম্পর্কে পবিত্র কোরাণ বলছে, “নামাজ মানুষকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে”। সুতরাং যে ব্যক্তির নামাজ তাকে অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়নি, আর যাই হোক ঐ নামাজ কখনোই বেহেস্তের চাবি হতে পারেনা। নামাজীর জন্য আল্লাহ-তা-আলার ওয়াদা, তার কখনো রিজেকের অভাব হবে না। কোন নামাজীর যদি রিজেকের অভাব থাকে তাহলে তার নামাজ কখনোই বেহেস্তের চাবি হতে পারে না।

প্রাত্যাহিক জীবনে নামাজের উল্লেখযোগ্য দিক হলো,

১। পাঁচবার যথাযথভাবে ওজু করলে শরীর-মন পবিত্র থাকে, রোগ-বালাই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে।

২। যথাযথভাবে রুকু-সিজদাহ করে নামাজ আদায় করলে ১০০%+ শারীরিক ও মানসিক ব্যায়াম এর কাজ সম্পন্ন হয়, যা সাধারণ ব্যায়াম এর মাধ্যমে কখনোই আশা করা যায় না।

৩। জামায়াতের সাথে নিয়মিত নামাজ আদায় করলে সামাজিক বন্ধন মজবুত হয়।

কিন্তু বাস্তবে আমাদের সমাজে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এর প্রভাব দেখা যায় না। আজকাল তো মসজিদে ‘চেয়ার’ এর দোকান খোলা হয়েছে। অনেকেই সারাদিন রাস্তাঘাটে ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়ান অন্যদিকে মসজিদে আসলে তাদের নাকি চেয়ার ছাড়া চলেই না। অথচ নামাজ সঠিকভাবে আদায় করলে শরীরে ‘বাত’ এর ব্যথাও থাকার কথা নয়।

বেহেস্ত-দোযখ থাক বা না থাক, এজগতের পরে যে অন্য একটি জগতে অনুপ্রবেশ করতে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সে জগতে সুখে থাকতে হলে প্রয়োজন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া কেউই সে জগতে সুখী হতে পারবেনা। কাজেই ইসলামী চিন্তাবিদদের উচিৎ “নামাজ বেহেস্তের চাবি”- বলে অপব্যাখ্যা না করে কিভাবে নামাজ এর দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে দুনিয়ার যাবতীয় সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা যায় সে পথ দেখানোর চেষ্টা করা। তাহলেই পৃথিবীটা হবে সুন্দর এবং সুখময়। আর এজগতে যারা ভালো ফসল ফলাবেন, পরজগতে তারাই ভালো ফসল কাটবেন, বেহেস্তের চাবির দরকার হবে না।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published.