“ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা/ ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ/ আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।/ রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে/ আজকে যে যা বলে বলুক তোরে/ সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক’রে/ পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।/ আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।” এটি বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত “ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা” কবিতার অংশ বিশেষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন (বৈশাখ-১৩২১/April-1914) তখন বাংলাদেশের অলিতে গলিতে প্রাইভেট/কোচিং গাইড বই এর ছড়াছড়ি তো দূরের কথা; এ দেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছিল না। আর এখন বাংলাদেশে মোট কতটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এমন প্রশ্ন করলেও তৎক্ষণাৎ তার উত্তর দেয়া অসম্ভব, কারণ এদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই এখন শিক্ষা ব্যবসায় নিয়োজিত। কাজেই কোনটি বিশ্ববিদ্যালয় আর কোনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সেটাই যদি আলাদা করতে না পারি তাহলে কিভাবে উত্তর দেবো, এদেশে মোট কয়টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সংখ্যাটা যাই হোক, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, সে দায়িত্ব পালন করার জন্য এখন আর কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় না, প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যবসা করার জন্য তাতে কোন সন্দেহ নেই।
শিক্ষা বলতে আসলে আমরা কী বুঝি? একজন মানুষের জন্য শিক্ষা কতটুকু জরুরী? মানুষ ভিন্ন অন্যান্য প্রাণির মাঝে কি কোন শিক্ষা ব্যবস্থা আছে? যদি তা না থাকে তাহলে অন্যান্য প্রাণিরা কিভাবে পৃথিবীর বুকে অভিযোজন/ উপযোজন করে থাকে? কেমন করে বাবুই পাখি গাছের ডালে এত চমৎকার করে বাসা বানায়? শিক্ষা নিয়ে এমন হাজারও জিজ্ঞাসা করা যেতেই পারে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে শিক্ষার প্রভাব কতটুকু সেটাই ভেবে দেখার বিষয়। বর্তমান জীবন ব্যবস্থায় মানুষের শিক্ষাকে মোটামুটি ৩টি স্তরে বিভক্ত করা যেতে পারে; এক. এলিমেন্টারি বা প্রাথমিক শিক্ষা অর্থাৎ লিখতে পারা, পড়তে পারা, হিসাব-নিকাশ করতে পারা, ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে পারা ইত্যাদি। দুই. সেকেন্ডারী শিক্ষা অর্থাৎ নিজে ভালো থাকার পাশাপাশি অন্যদেরকেও ভালো রাখার জন্য কাজ করতে পারা। তিন. উচ্চ স্তরের শিক্ষা অর্থাৎ সমাজ-রাষ্ট্র-জাতি ও দেশ তথা বিশ্বটাকে সুন্দররূপে সাজাতে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারা। আর বাস্তবতা হচ্ছে আমরা শিক্ষাকে নিয়েছি রুটি-রুজির যোগান দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে। যদি শিক্ষাটা কেবলমাত্র এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো তাহলেও হয়তো বলার তেমন কিছু থাকতো না। কিন্তু শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় কারি কারি টাকা উপার্জন করা তাহলে সে শিক্ষার জায়গাটা যে জন্তু-জানোয়ারের শিক্ষার থেকেও নিচে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, একটা হিংস্র প্রাণি পেট ভরা থাকা অবস্থায় নতুন শিকারের কথা চিন্তা করে না, কিন্তু মানুষ করে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী যার কথাই বলি না কেন, তারা যতই টাকার পাহাড় গড়ুক না কেন, টাকার চাহিদা তাদের কখনোই পূরণ হয় না। এ দেশে হাসপাতালে লাশ রেখে যেমন টাকা আদায় করা হয়, তেমনি সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়ানোটাও একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কাজের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের দেশের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ।
শিক্ষা নিয়ে যদি নবীনরা উজ্জিবীত না হয়, শিক্ষা নিয়ে যদি কঁচিকাঁচারা ভালো কাজে ঝাঁপিয়ে না পড়ে তাহলে এমন শিক্ষার কী প্রয়োজন? বেঁচে থাকার জন্য যে শিক্ষা তা প্রকৃতি প্রদত্ত। গরু-ছাগল বা অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণির বাচ্চারা ভূমিষ্ট হওয়ার কিছুক্ষণ পরই খুঁজে বের করে বেঁচে থাকার জন্য খাবার (মাতৃদুগ্ধ) কোথায় পাওয়া যাবে। এটা মহান সৃষ্টিকর্তার বিধান তথা এই শিক্ষাটা সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতি প্রদত্ত। মানব শিশুর ক্ষেত্রে কিছুক্ষণ পর না হলেও একটা নির্দিষ্ট সময় পর মানব শিশুও তার নিজের জন্য অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়; যদি তাকে একাকী নির্জন কোন দ্বীপে রেখে আসা হয় তাহলেও। সুতরাং শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যে, কারি কারি টাকা উপার্জন করা নয়, এ বিষয়টা পরিষ্কার।
গতিময় পৃথিবী অতি দ্রুত তার গতি বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সুতরাং মানুষ যদি তার গতি পরিবর্তন করতে না পারে তাহলে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকাটাই মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। আমি বর্তমানের নতুন শিক্ষা কারিকুলাম সম্পর্কে এখনো তেমন স্ট্যাডি করিনি তথা এ বিষয়ে আমার খুব একটা ভালো ধারণা নেই। তবে এ কারিকুলামে যাই থাক না কেন, আমি সব সময়ই পরিবর্তনের পক্ষে; কারণ পরিবর্তনের অপর নাম গতি আর গতি মানেই জীবন তথা জীবন মানেই গতি। আজ যারা নতুন শিক্ষা কারিকুলামের বিরুদ্ধে কথা বলেন তাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, বলুন তো প্লে থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত সকল স্তরে ইংরেজীকে বাধ্যতামূলক বিষয় করা হলেও কেন আমাদের ছেলে-মেয়েরা ইংরেজীতে কথা বলা তো দূরের কথা সুন্দরভাবে গুছিয়ে কিছু লিখতে বললেও তা পারে না? কেন বাবা-মা দু’জনই শিক্ষিত হওয়া স্বত্ত্বেও তারা তাদের সন্তানের জন্য কোচিং বা প্রাইভেট শিক্ষক এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন? আপনি যদি শিক্ষিত হয়ে থাকেন তাহলে বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনার শিক্ষা জীবনে অর্জিত জ্ঞান আপনি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করেন কি না বা করতে সক্ষম কি না? বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতির কথা বাদই দিলাম; মাস্টার্স পাশ করা খুব অল্প সংখ্যক পিতা-মাতা আছেন যারা তাদের সন্তানদের স্কুল লেবেলের অংক শেখাতে সক্ষম। এর পরেও কি বলা যায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আগে ভালো ছিল?
বিখ্যাত দার্শনিক/সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছিলেন, “তোমরা আমাকে ভাল(শিক্ষিত) মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটা মহৎ জাতি উপহার দিব”(“Give me good mothers and I shall give you a great nation!”)। তিনি এ কথা বলেছিলেন, কারণ তার ধারণা ছিল, একজন শিক্ষিত মা তথা শিক্ষিত পিতা-মাতা তাদের সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দিতে সক্ষম হবেন। কিন্তু আমাদের দেশের খুব কম সংখ্যক শিক্ষিত পিতা-মাতাই তাদের সন্তানকে সুশিক্ষা দিতে সক্ষম। আর এ কারণেই তারা তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেন কোচিং সেন্টার বা প্রাইভেট শিক্ষকের ওপর। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করেছি, কিন্তু নিজের সন্তানের প্রাথমিক-হাইস্কুলের পাঠ্যবই গুলো পড়ানোর সক্ষমতা আমার নেই, তার পরেও আমি একজন শিক্ষিত, সত্যিই আজব, তাই না? আমি জানি, আমার এ প্রশ্নের জবাবে অনেকে বলবেন, সন্তানকে পড়ানোর সময় পাইনা কিংবা সন্তান আমার কাছে পড়তে চায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতা হলো একজন দম্পতি চাকরি-ব্যবসা যাই করুক না কেন, নিজের সন্তানকে পড়ানোর জন্য তার হাতে যথেষ্ট সময় রয়েছে। আর যারা বলেন আমার সন্তান আমার কাছে পড়তে চায়না, এর জন্য তিনি দায়ী নন বরং এর জন্য দায়ী আমাদের অপরিপক্ক শিক্ষা কারিকুলাম। কারণ শিক্ষা মানে পাঠ্যপুস্তকের কতগুলো বিষয় মুখস্থ করে উগড়িয়ে দেয়া নয়; শিক্ষা মানে একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থেকে অন্যদেরকে অনুকরণ করা নয়। শিক্ষা মানে জ্ঞানের সীমাহীন জগতে স্বাধীনভাবে বিচরণ করা; শিক্ষা মানে আপন সৃজনশীলতাকে অন্যদের সম্মুখে উপস্থাপন করা। কিন্তু আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে এরূপ সুযোগ নেই বললেই চলে।
আমাদের নতুন শিক্ষা কারিকুলামে যথেষ্ট ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতেই পারে। আমি যদি সত্যিই শিক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকি তাহলে আমার কাজ নতুন শিক্ষা কারিকুলামের বিরোধীতা করা নয়, আমার কাজ হলো নতুন কারিকুলামের ত্রুটিগুলো তুলে ধরা; ভালো কোন আইডিয়া থাকলে তা প্রকাশ করা। পুরাতন জরাজীর্ণ শিক্ষা কারিকুলাম আঁকড়ে ধরে হাহুতাশ করা আর যাইহোক, কোন জ্ঞানীজনের কথা হতে পারে না। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ও গতিময় পৃথিবীতে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে পরীক্ষা/ সনদপত্র নির্ভর শিক্ষা কারিকুলাম থেকে বেড়িয়ে আসার কোন বিকল্প নেই। যেকোন ধরণের শিক্ষা তখনি আনন্দময় হতে পারে যখন তা অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীকে কোন ধরণের মানসিক চাপ সহ্য করতে হয় না। কিন্তু পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা কেবলমাত্র চরম মানসিক চাপই সহ্য করে না, বরং এই শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের চিন্তন/ সৃজনশীল ক্ষমতাকে ক্রমশঃ বিকল করে দিচ্ছে। ফলে একাডেমিক শিক্ষা শেষ করার পরেও এখনকার শিক্ষার্থীরা নিজের যোগ্যতার ওপর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয় না। আর এরই ধারাবাহিকতায় একাডেমিক শিক্ষা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ তথা একটা চাকরি প্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জনের জন্য আবার তারা ছুটে চলে কোন প্রাইভেট কিংবা কোচিং সেন্টারের দিকে, যা কোনভাবেই কাম্য নয়। শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিৎ যেখানে শিক্ষার্থীরা যা কিছু শিখবে, আনন্দের সাথে শিখবে। একাডেমিক শিক্ষা শেষ করে কেবলমাত্র সনদপত্র অর্জনই নয়, বরং শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠুক, এটাই সকলের প্রত্যাশা হওয়া উচিৎ।
মোঃ আব্দুল হাই খান
পরিচালক
গাইবান্ধা কম্পিউটার এন্ড আইটি এডুকেশন।
E-mail: haikhan2002@gmail.com
গঠনমুলক আলোচনা