সাধারণভাবে বলতে গেলে শিক্ষাগ্রহণের প্রধান এবং উত্তম স্থান হচ্ছে বিদ্যালয়। কিন্তু সত্যিই কি আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা দেয়া হয়? আমি বলবো, একদমই না। বরং এদেশের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের কতকগুলো পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হয়। পাশাপাশি তাদেরকে সেগুলো পড়ে কিভাবে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া যাবে তার কলাকৌশল শেখানো হয়।
কৃষি বিষয়ে পাঠদান করার পর যদি শিক্ষার্খীর মাঝে পশুপালন, বাগান করা কিংবা কলম দিয়ে চারা তৈরীর আগ্রহ না জন্মায় তাহলে উক্ত শিক্ষা অনর্থক। তেমনিভাবে ধর্মীয় বিষয়ে পাঠদান করার পর যদি শিক্ষার্থীর মাঝে ধর্মানুভূতি জাগ্রত না হয় অর্থাৎ বাস্তব জীবনে সে নিজ নিজ ধর্মীয় বিধানগুলো মেনে না চলে তাহলে একটি জাতি ধ্বংসের জন্য এটাই যথেষ্ট।
আজ বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস মহামারীরূপে দেখা দিয়েছে এবং তা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ স্ব স্ব দেশের সরকার কর্তৃক নানা বিধিনিষেধ জারী করা হচ্ছে। অথচ উক্ত বিধিনিষেধগুলো মানার ক্ষেত্রে আমরা উদাসীন। কারণ আমরা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অজ্ঞ। যদি শিক্ষার্থীদের মাঝে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে জ্ঞান থাকে তাহলে যেকোন পাড়া, মহল্লা কিংবা গ্রামকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সেই এলাকার যুব সমাজই যথেষ্ট। একটি গ্রাম মানেই তো একটি দেশ। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের যুব সমাজের মাঝে সেই শিক্ষা নেই। এখনকার যুব সমাজ বিদ্যালয় থেকে সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে না। বরং বিদ্যালয়গুলো পরীক্ষার মাধ্যমে একটা সনদপত্র প্রাপ্তির লক্ষ্যে কতকগুলো পাঠ্যপুস্তক পড়ায় যদিও অধিকাংশ শিক্ষার্থীর নিকট তা যথেষ্ট মনে হয় না। তাই তাদেরকে আবার ছুটতে হয় কোন নামী-দামী কোচিং সেন্টারের দিকে। আর যাদের পিতা-মাতার অঢেল আছে তারা সন্তানের জন্য ডজনখানিক হাউস টিউটরের ব্যবস্থা করে ফেলেন অনায়সে।
বিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে আমাদের শিক্ষার্থীরা শেখে কিভাবে শর্টকাটে একটা ভাল রেজাল্ট লাভ করা যায়। আর লেখাপড়া শেষ করার পর চেষ্টা করে কিভাবে শর্টকাটে একটা ভালো চাকুরী যোগাড় করা যায়, তাতে যদি মোটা অংকের ঘুষ দিতে হয় হোক। অবস্থা এমন যে চাকুরীটা কেবল তারই প্রাপ্য, তাই মেধায় না হলে প্রয়োজনে ঘুষ দিয়ে হলেও হতে হবে। লেখাপড়া শেষ করার পর যদি কোন শিক্ষার্থী ঘুষ দিয়ে হলেও একটা চাকুরী যোগাড় করা তার দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করে, আর যাইহোক ঐ ব্যক্তি দ্বারা জাতির কোন কল্যাণ হতে পারে না।
আজ বেসরকারী শিক্ষক সমাজ চিৎকার করে তাদের দুঃখ বেদনার কথা সরকারের/জাতির নিকট তুলে ধরছে, অথচ এটা সংশ্লিষ্ট কোন মহলকে নাড়া দিচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ যারা আজ সরকার পরিচালনা করছে তারা তো কোন না কোন বিদ্যালয়েই পড়েছেন। আর বিদ্যালয় তো তাকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সচেতন করতে পারেনি। বরং শিক্ষাজীবনে সে শিখেছে কিভাবে শর্টকাটে ভালো নম্বর নিয়ে একটা ভালো রেজাল্ট করা যায়, শিক্ষাজীবন শেষে চেষ্টা করেছে কিভাবে শর্টকাটে একটা ভালো চাকুরী যোগাড় করা যায়। আর কর্মজীবনে সে চেষ্টা করছে কিভাবে শর্টকাটে টাকার পাহাড় করা যায়। সুতরাং আজ শিক্ষকদের দূর্দশার কথা সে কেন শুনবে? নিম গাছ লাগিয়ে যদি কেউ আম খেতে চান সেটা কি আদৌ সম্ভব?
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন। সমাজের মানুষগুলো এখন ভুলেই গেছে রাষ্ট্রের সাথে সমাজের সম্পর্ক কী। পরিশুদ্ধ সমাজ ব্যতীত পরিশুদ্ধ রাষ্ট্র/সরকার অসম্ভব। আর সমাজের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে বিদ্যালয়। একটি সমাজকে পরিশুদ্ধ করার জন্য বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু বর্তমানে বিদ্যালয়গুলো পরিশুদ্ধ সমাজ গঠনে কোন ভূমিকা রাখেনা, কারণ বিদ্যালয় তো নিজেই নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা ভুলে গেছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন রাজনীতির ঘোলাজলে হাবুডুবু খাচ্ছে। অবশ্যই শিক্ষকরা সরকার গঠনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন; কিন্তু শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকা অবস্থায় কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে কাজ করা প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য একটি জঘন্যতম কাজ। যে শিক্ষক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন পদ পদবীর আশায় নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে আত্মসম্মানকে জলাঞ্জলি দেয় ঐ শিক্ষক জাতির জন্য কলঙ্ক।
যাদের নিঃস্বার্থ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন জাতি, শিক্ষকদেরকে আগে তাদের নিকট থেকে শিক্ষা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, দূর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যতিত দূর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র/সরকার গঠন কখনোই সম্ভব নয়। আর বিদ্যালয়ের পক্ষেই সম্ভব একটি দূর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। শিক্ষকরা যদি নিজের পাওয়া না পাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে দূর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে আত্মনিয়োগ করতে পারে তবেই একটি দূর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র/সরকার গঠিত হবে। আর রাষ্ট্র/সরকার দূর্নীতিমুক্ত হলে শিক্ষকদের কখনোই আন্দোলন করার প্রয়োজন হবে না। নিজে ত্যাগ স্বীকার করে স্বাধীনতাকামী মুক্তিপাগল মানুষগুলোর মত আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে শিক্ষকরা নিজেদেরকে বদলাতে না পারলে জাতীয় বৈষম্যসমূহ দূর করা কখনোই সম্ভব হবে না।