পবিত্র কোরাণে মহান আল্লাহ-তা-আলা ‘রিবা’ এর ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। সুতরাং আল্লাহ-তা-আলার প্রতি যারা বিশ্বাস স্থাপন করবেন, ‘রিবা’ থেকে বিরত থাকা তাদের জন্য একটি ঈমানী দায়িত্ব। আল্লাহ-তা-আলা যেহেতু কোরাণে ‘রিবা’ কে হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন সেখানে এ বিষয়ে বিতর্কে না গিয়ে ‘রিবা’ থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। আরবী ‘রিবা’ এর প্রতিশব্দ হিসেবে বাংলায় ‘সুদ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু জাহেলী যুগে যে ধরণের অর্থনৈতিক লেন-দেনকে ‘রিবা’ বলা হতো, বর্তমান ব্যাংকিং কার্যক্রম কি তার সাথে পুরোপুরি মিলে যায়? বর্তমান বিশ্বে ব্যাংকগুলো ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করা ছাড়াও আরো অসংখ্য কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। একথা ঠিক যে, ব্যাংকগুলোর ঋণদান কার্যক্রমের মাঝে যথেষ্ট ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। কিন্তু ঋণ প্রদান কার্যক্রম ছাড়াও ব্যাংকগুলো আরো যেসকল কার্যক্রম সম্পাদন করে থাকে সেগুলোও কি হারাম? যদি তা না হয় তাহলে বলতে হবে ‘সুদ’ হারাম তবে ব্যাংক ব্যবস্থা হারাম নয়?

অন্যদিকে যদি ব্যাংক ব্যবস্থা হারাম হয় তাহলে প্রথমত: বিশ্বের যেসকল দেশে ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় বা চালু আছে তারা কি ভুল পথে আছে? দ্বিতীয়ত: যদি ধরেই নেয়া যায়, ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয় এবং যারা এরকম ধারণা পোষণ করেন তাদের তো কোন রাষ্ট্রেই বসবাস করা উচিৎ নয়। কেননা, রাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রত্যেক নাগরিকই রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকেন। পৃথিবীতে এমন কোন রাষ্ট্র সম্ভবত একটিও নেই যে রাষ্ট্রে ব্যাংকিং সিস্টেম চালু নেই। আর সকল রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনার সাথে ব্যাংক ব্যবস্থা নিবিড়ভাবে জড়িত। একজন মানুষ দৈনন্দিন জীবনে যেসকল জিনিস ব্যবহার করে থাকে সেগুলোর সবই কোন না কোনভাবে ব্যাংক ব্যবস্থার সাথে জড়িত। রান্নাঘর থেকে শুরু করে প্রযুক্তির অন্যতম আবিষ্কার মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেটসহ সবকিছুর সাথেই জড়িয়ে আছে অর্থ এবং ব্যাংক। তাহলে কি আমি প্রযুক্তির সুফলগুলো ভোগ করবো না? আমি যে যানবাহনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমণ করছি যানবাহনটির মালিক কিন্তু ওটা ঋণের টাকায় কিনেছে। তবে কি আমি যানবাহনে ওঠা বন্ধ করে দেবো? কেননা, যানবাহনে ওঠা মানেই হচ্ছে ওটার মালিককে ঋণ নিতে আরো বেশী উৎসাহিত করা। আর যদি নিজের আরাম-আয়েশের কথা মাথায় নিয়ে যানবাহনে আরোহন করি তাহলেতো পরোক্ষভাবে আমি সংশ্লিষ্ট যানবাহনের মালিকের ব্যবসার উন্নয়নেই সহযোগিতা করলাম। যদি পায়ে হেঁটে চলি, তাহলে? রাস্তা নির্মাণের সাখে কি ব্যাংক জড়িত নয়? একজন মানুষ কোন এক স্থানে বসে থেকে যেদিকেই চোখ ঘুরাক না কেন, সর্বত্রই রয়েছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। আর যেখানেই প্রযুক্তি, সেখানেই অর্থ, সেখানেই ব্যাংক। অর্থাৎ কোন মানুষ না চাইলেও ব্যাংকের সুবিধা গ্রহণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন না। প্রত্যক্ষভাবে হোক আর পরোক্ষভাবেই হোক, তার জীবন ব্যবস্থার সাথে ব্যাংক ব্যবস্থা জড়িয়ে আছে নিবিড়ভাবে। সরকারী চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার পর পেনসন নেন না, এমন মানুষ পৃথিবীর কোন দেশে আছে বলে আমার মনে হয় না। নিজে তো নেনই, মারা গেলে তার স্ত্রীও পাবেন। এই পেনসনের টাকাটা সরকার কোথা থেকে দেয়? এর সাথে কি ব্যাংক জড়িত নয়?

ফলের কোন অংশ পচে গেলে সে অংশ বাদ দিয়ে (সব ফল নয়) বাকী অংশ খাওয়া যেতেই পারে। পচা ফল খাওয়া সম্ভব নয় বলে কি পুরো ফলটিকে ছুঁড়ে ফেলতে হবে? যেখানে ব্যাংক ব্যবস্থা মানুষের জীবনের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে চাইলেও তা থেকে বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই, সেখানে ‘সুদ’ এর বিরোধীতা করতে গিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থার বিরোধিতা না করে বরং কিভাবে ব্যাংকগুলো ‘সুদ’ মুক্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে সে ব্যাপারে পরামর্শ/মতামত প্রদান করলে সেটাই হবে মানুষের জন্য ক্যলাণকর।

সেদিন খুব বেশী দূরে নেই যেদিন মানুষের কাছে কাগুজে টাকার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। এখনই মানুষ অর্থ লেন-দেন করছে ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে। ভবিষ্যতে ইলেকট্রনিক মাধ্যমই হবে অর্থ লেন-দেন এর সর্বোত্তম মাধ্যম। তাহলে যারা আজ ব্যাংক ব্যবস্থার বিরোধিতা করছেন তারা বেঁচে থাকলে কি প্রযুক্তির সেই সুফল নেবেন না। আর ইলেকট্রনিক অর্থ লেন-দেন হবে কোন না কোন ব্যাংক বা অনুরূপ কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ইতোমধ্যেই আমরা নিজের অজান্তেই দ্বিধাহীনভাবে বিকাশ/রকেট/নগদ ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থ লেন-দেন করছি। এরপর আরো কী আসতে চলেছে তা অনুমান করা বোধ হয় খুব একটা কঠিন নয়। তাহলে খামোখাই ‘সুদ’ এর বিরোধিতার নামে কেন আমরা ব্যাংক ব্যবস্থার বিরোধীতা করছি? ব্যাংক ব্যবস্থার বিরোধীতা না করে বরং আসুন আমরা একসাথে আওয়াজ তুলি, ‘ব্যাংক ব্যবস্থার সংস্কার চাই, সুদ মুক্ত ব্যাংক চাই’। ব্যাংকগুলোর যেসকল কার্যক্রম আংশিক কিংবা পুরোপুরি জাহেলী যুগের ‘রিবা’ এর সাথে মিলে যায় সেগুলো সংশোধন করে ‘সুদ’ শব্দটি অন্যকোন শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হলে ব্যাংক ব্যবস্থাই হতে পারে আধুনিক জীবন ব্যবস্থার অন্যতম সহায়ক শক্তি। ইসলামী চিন্তাবিদসহ প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের এটাই কাম্য হওয়া উচিৎ।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published.