আজ সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ না ফেরার দেশে। আমি রাজনীতি বুঝি না, তবে এতটুকু বুঝি যে, ১৯৯০ সনে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এমনকি মৃত্যুর পরেও বিভিন্ন প্রেস মিডিয়া এবং টিভির পর্দায় অনেকের মুখেই তাকে স্বৈরশাসক তথা একজন ঘৃণ ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে দেখা গেছে এবং যাচ্ছে। আমরা জানি, প্রত্যেক দেশেই যেকোন শাসকের আমলেই তার শাসন ব্যবস্থা ভাল-মন্দ যাই হোকনা কেন, কিছু না কিছু ভাল কাজও হয়ে থাকে। অথচ ক্ষমতা হারানোর পর তার ভাল কাজগুলো আড়াল করে কেবল ত্রুটিগুলোকেই বেশী বেশী করে জাহির করা হয়। সম্ভবত বাংলাদেশ ভিন্ন পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয় না।

এরশাদ এর সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ছিল না, তাই এরশাদকে স্বৈরশাসক বলা হয়। কিন্তু ভোটে নির্বাচিত হলেই কি তাকে গণতান্ত্রিক সরকার বলা যায়? যদি তাই হবে তাহলে তো এরশাদ পরবর্তী কোন সরকারের পতনের জন্য আন্দোলন করার কথা নয়। তাহলে ২০০৬ সালে বি.এন.পি সরকারের পতনের জন্য যে আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছিল সেটা কিসের জন্য? বর্তমান সরকার টানা ৩য় বারের মত সরকার পরিচালনা করছে। প্রথম টার্মের নির্বাচন সম্পর্কে তেমন কোন অভিযোগ না থাকলেও, পরবর্তী দুই টার্মের সরকার গঠন নিয়ে রয়েছে চরম ধোঁয়াশা। আমি যেহেতু রাজনীতি বুঝি না, তাই নির্বাচন নিয়েও আমার খুব একটা মাথাব্যথা নাই। কিন্তু আমার প্রশ্ন একটা্ই, যখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে নামাতে হয়, কিংবা ভোটে নির্বাচিত হলেও বলা হয় কারচুপি করে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে, সেখানে স্বৈরাচার বলতে আসলে কী বুঝানো হয়? সামরিক শাসন তো আর এমনি এমনি জারি হয় না। এটা একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে উদ্ভুত হয়। তাহলে কেবলমাত্র সামরিক শাসক হওয়ার কারণে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কে স্বৈরাচার বা স্বৈরশাসক বলা কতখানি যুক্তিসঙ্গত?

এরশাদ সরকারের পতনের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে সত্য। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার পতনের আন্দোলনের সময় ঠিক কতজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল কিংবা পেট্রোল বোমায় নিহত হয়েছিল তার হিসেব কি আমরা জানি? যখন আন্দোলন করে কোন সরকারের পতন ঘটানো হয় তখন সে আন্দোলনের পিছনে কিছু একটা কারণ তো অবশ্যই থাকে। তাই বলে ঐ সরকারের পতনের পর কেবল তার দোষগুলোকেই জাহির করতে হবে, আর গুণগুলোকে আড়াল করতে হবে এটা কোন সুস্থ চিন্তা হতে পারে না।

আজ এরশাদ নেই, ভবিষ্যতে তার গঠিত দলও থাকবে কি না সন্দেহ। কিন্তু তিনি তার শাসনামলে যেসব জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন আমরা তার সুফল ভোগ করবো অথচ স্বীকার করবো না, এটা হতে পারে না। মহুকুমা থেকে জেলা, উপজেলা, গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ, যোগাযোগের জন্য মহাসড়ক নির্মাণ, শুক্রবার ছুটির দিন ঘোষণা, রেডিও-টিভি তে আযানের প্রচলন করা, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা, উপাসনালয় ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিল মওকুফ, শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরী নির্ধারণ, চাকুরীজীবিদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, গ্রামিণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় সমর্থন সহ রয়েছে উল্লেখযোগ্য নানা অবদান। অথচ আমরা এমনই এক জাতি, যেখানে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য আন্দোলন করতে হয়, সেখানে কেবলমাত্র সামরিক শাসক হওয়ার কারণে তার অবদানগুলোকে স্বীকার না করে কেবলমাত্র তার ত্রুটিগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করতেই আমরা বেশী পছন্দ করি। তাই জাতির কাছে আমি বিনয়ের সাথে বলতে চাই, প্লীজ আপনারা যদি পরলোকগত একজন সাবেক রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে ঘাটাঘাটি করতেই চান, তাহলে কেবলমাত্র তার ত্রুটিগুলো নয় বরং অবদানগুলোরও একটা তালিকা তৈরী করে তুলনামূলক বিচার করুন। সেইসাথে এরশাদ সরকারের সাথে এরশাদ পরবর্তী অন্যান্য সরকারেরও তুলনামূলক বিচার করুন। আমার বিশ্বাস, তখন আপনাদের মনে হবে, এরশাদের শাসনামল ভাল না হলেও অন্যান্য সরকারের শাসনামলের থেকে খুব একটা খারাপ ছিল না।

একজন সামরিক শাসকের অবস্থা তো ঠিক ঐ যুবকের ন্যায়, যাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেয়ে যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট সেবনকারী কোন যুবতী নারী আলিঙ্ঘন করে গর্ভবতী হয়। ঘুম ভাঙার পর উক্ত যুবক নিজেকে না পারে ঐ নারীর স্বামী পরিচয় দিতে, না সে ঐ নারীর ধর্ষক। এ অবস্থায় উক্ত নারীকে ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়া যেমনটা সহজ নয়, তেমনি তাকে বিয়ে করে রাতারাতি বৈধ স্ত্রীর মর্যাদা দেয়াটাও সহজ নয়। যদি কোনভাবে বিয়ে করে বৈধ স্ত্রীর মর্যাদা দেয়া সম্ভব হয়, তাহলে ঘুমের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা সকলের স্মৃতি থেকে সহজেই মুছে যাবে নিশ্চিত; নয়তো অপরাধ না করেও তাকে একটা অপরাধের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে সারাটা জীবন ধরে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এর যথেষ্ট অবদান থাকা স্বত্ত্বেও তিনি কখনোই তার জীবদ্দশায় সে অবদানগুলো জনসম্মুখে উপস্থাপনের উদ্যোগ নেননি বা চেষ্টা করেননি, কারণ তার ভিতরে ঐ ঘুমন্ত যুবকের ন্যায় এক ধরণের অপরাধ বোধ কাজ করছিল। কেননা ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও নিজেকে এদেশের একজন বৈধ স্বামী (রাষ্ট্রপতি) হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেননি। আমরা যদি এরশাদ পরবর্তী কোন সরকারের সময়ে আর কখনোই ক্রাইসিসে না পড়ে থাকি তাহলে আমি বলবো এরশাদ এর শাসন ব্যবস্থা সত্যিই নিঃকৃষ্ট ছিল। তা না হলে আমাদের উচিৎ তার ভুলগুলোকে ভুলে গিয়ে তার অবদানগুলোকে সামনে এনে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার ও সম্মান জানানো।

মোঃ আব্দুল হাই খান
পরিচালক
গাইবান্ধা কম্পিউটার এন্ড আইটি এডুকেশন।
E-mail: haikhan2002@gmail.com

রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে এরশাদের সেরা ১০০ অবদান সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published.