সাধারণভাবে ‘নামাজ’ বলতে বুঝায় প্রার্থনা। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সুরা/কিরায়াত আবৃত্তি এবং যথাযথ বডি ল্যাঙ্গুয়েজ উপস্থাপনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক বিশেষ প্রচেষ্টার নাম ‘নামাজ’। এটা মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত মানব সম্প্রদায়ের জন্য এমন এক মোজেজা, যা খুব কম মানুষই উপলব্ধি করতে সক্ষম। একজন মানুষ তার জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে পারেন একমাত্র ‘নামাজ’ এর মাধ্যমে। কিন্তু বেশীরভাগ মানুষই/মুসলমানই তা পারেন না। কেননা, অধিকাংশ মানুষই নামাজ আদায় করেন আল্লাহর ভয়ে। আর নামাজের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রয়োজন ভক্তি।

কোন মানুষ আল্লাহকে ভয় করেন, একথার অর্থ হচ্ছে তিনি আল্লাহর অস্তিত্ত্বকে অস্বীকার করার মত দুঃসাহস দেখান না। পক্ষান্তরে কোন মানুষ আল্লাহর ভয়ে নামাজ আদায় করেন, এটি সঠিক নয়। নামাজ হচ্ছে বিনয়ের সাথে আল্লাহর দরবারে বান্দার আরজী উপস্থাপনের সর্বোত্তম মাধ্যম। ভয়ের সাথে আরজী উপস্থাপন করা কতটা বাস্তব সম্মত সেটা অনুধাবনের বিষয়। আবার একইসাথে ভয় ও ভক্তি প্রদর্শন, সেটাও অস্বাভাবিক। বস্তুতঃ কোন মানুষের মাঝে যখন আল্লাহর অস্তিত্ত্বকে অস্বীকার করার ভয় কাজ করে, তখনই তার পক্ষে ভক্তিসহকারে আল্লাহর নিকট নিজের প্রয়োজনের কথা তুলে ধরা সম্ভব।

নামাজের প্রত্যেক রাকাতের শুরুতে সুরা ফাতিহা পাঠ করা হয়, যার অর্থ “(১) যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা। (২) যিনি নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু। (৩) যিনি বিচার দিনের মালিক। (৪) আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। (৫) আমাদেরকে সরল পথ দেখাও, (৬) সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ। (৭) তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।” অর্থাৎ সম্পূর্ণ সুরাটিই হচ্ছে একটা প্রার্থনা যা বারবার আবৃত্তি করতে হয় বিনম্র চিত্ত্বে। ভয় ও নম্রতা দুটো একসঙ্গে অবস্থান করে না। কেননা, ভয় ও নম্রতার শাব্দিক অর্থ ভিন্ন হলেও এর প্রয়োগিক অর্থ একই। ভয় করার অর্থ নতি স্বীকার করা আর নম্রতাও নতি স্বীকার করারই দৃষ্টান্ত।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা আলা নামাজ আদায় করতে বলেছেন খুশু-খুযুর সাথে। সুরা বাকারার ২৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “সমস্ত নামাজের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাজের ব্যাপারে। আর আল্লাহর সামনে একান্ত আদবের সাথে দাঁড়াও”। “বস্তুতঃ মুমিনগণই সফলকাম, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র(সুরা মোমেনুন/১-২)”। কুরআন হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী নামাজের প্রাণ হচ্ছে “খুশু-খুযু” যার অর্থ হ’ল স্থিরতা, ধীরতা, গাম্ভীর্য, বিনয় ও নম্রতা ইত্যাদি তথা নিজেকে ধীরতা ও বিনয়ের সাথে প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থাপন করা। নামাজের যাবতীয় ফযিলত, প্রভাব ও উপকারিতা এই খুশু-খুযুর সাথেই সম্পৃক্ত। যদি নামাজী খুশু-খুযুর সাথে নামায আদায় না করেন, তাহলে তার নামাজ কখনোই পার্থিব দায়িত্বমুক্তি ব্যতীত ইহকাল ও পরকালে আর কোন ফায়দা বয়ে আনতে পারেনা। কেননা, খুশু-খুযুবিহীন নামাজের দৃষ্টান্ত মৃত লাশের ন্যায়, যার কোন প্রাণ নেই। তবে “খুশু-খুযু” দ্বারা কেবলমাত্র অন্তরের ভীতি ও নম্রতাকেই বুঝায় না বরং দৈহিক ও বাহ্যিক বিনয় ও নম্রতাকেও বুঝানো হয়।

বস্তুতঃ নামাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা কেবলই আল্লাহর গুণকীর্ত্তন করি এবং সাথে সাথে তার নিকট আমাদের চাওয়া-পাওয়ার কথা তুলে ধরি, যেমন- রুকুতে- ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম’ এর অর্থ ‘আমার মহান মর্যাদাশীল প্রভুর পবিত্রতা বর্ণনা করছি’; রুকু থেকে দাঁড়িয়ে- ‘সামি আল্লাহুলিমান হামিদাহ’ এর অর্থ ‘যে আল্লাহ’র প্রশংসা করে তিনি তা শোনেন’ এবং ‘রাব্বানা লাকাল হামদ’ এর অর্থ ‘সকল প্রশংসা আল্লাহ’র জন্য’; সিজদায়- ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা’ এর অর্থ ‘আমার শ্রেষ্ঠ প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা করছি’; দুই সিজদার মধ্যবর্তী- ‘আল্লাহু ম্মাগ ফিরলী ওয়ার হামনি ওয়াহদিনি ওয়ার যুক্কনী ওয়া আফিনি’ এর অর্থ ‘হে আল্লাহ আপনি আমাকে মাফ করুন, আমাকে রহম করুন, আমাকে হেদায়েত দান করুন, আমাকে রিজিক দান করুন এবং আমাকে সুস্থতা দান করুন’। আর মহান আল্লাহ এতটাই দয়ালু যে, কেউ আল্লাহকে অন্তর থেকে স্মরণ করলে তিনি তৎক্ষনাৎ তার ডাকে সাড়া দেন এবং এটা আল্লাহর ওয়াদা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা সাধারণত মুখস্তভাবে নামাজ আদায় করে থাকি তথা একটা অটোমেটিক মেশিনের মত উঠবস করি। মুখে মুখে সুরা-কিরায়াত পড়লেও সূরা-কিরায়াতের মর্মবাণী আমাদের অন্তর পর্যন্ত খুব একটা পৌঁছে না। ফলে ‘নামাজ’ এর মর্মবাণী আমাদের অন্তর-আত্মা পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারে না। আর নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জন ব্যতিত উক্ত নামাজ দ্বারা আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের কোন সমস্যারও সমাধান করা সম্ভব হবে না।

সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, মানুষ যদি বিনম্র চিত্ত্বে অর্থাৎ খুশু-খুযুর সাথে নামাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন, তাহলে উক্ত নামাজী ব্যক্তি তার নামাজের প্রতিদান দুনিয়াতেই প্রাপ্ত হবেন। অর্থাৎ দুনিয়ার যাবতীয় প্রয়োজন মেটানো আল্লাহ তা আলা তার জন্য সহজ করে দেন। আর যিনি দুনিয়াতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবেন তার জন্য পরকালে আলাদা করে কিছু চাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *