প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের গতিধারা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ নানা কারণে, নানা ভাবে অর্থ লেন-দেন করে থাকে। আর এই বহুমূখী আর্থিক কর্মকান্ডেরই একটি কান্ডের নাম হচ্ছে ‘সুদ’ যা ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী সম্পূর্ণরূপে হারাম বা নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআনে ‘সুদ’ সম্পর্কে কঠোর হুসিয়ারী প্রদান করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন ধরণের লেন-দেনকে সুদ বলা হয়? পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারা (আয়াত: ২৭৫-২৮০), সুরা আল ইমরান (আয়াত: ১৩০), সুরা নিসা (আযাত: ১৬১) এবং সুরা রূম (আয়াত: ৩৯) এ ‘সুদ’ এর বিষয়ে উল্লেখ আছে যার মধ্যে সুরা আল ইমরান এর ১৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না।”। অর্থাৎ ‘সুদ’ এর সাথে চক্রবৃদ্ধি বিষয়টি জড়িয়ে আছে।
অন্যদিকে হাদীস এর আলোকে ‘সুদ’ সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় তার মাধ্যমে বর্তমানে প্রচলিত সকল আর্থিক লেন-দেন কে সংজ্ঞায়িত করা ততটা সহজ ব্যাপার নয়। কেননা, জাহেলী যুগের মানুষের মাঝে যেরূপ অর্থনৈতিক লেদ-লেন বলবৎ ছিল বর্তমানের অর্থনৈতিক লেন-দেন সেরূপ নয়। প্রসঙ্গত বলতে হয়, জাহেলী যুগে ‘সুদ’ এর কারবারটা এতটাই পরিচিত ছিল যে, ‘সুদ’ কাকে বলে এটা কাউকে ব্যাখা করে বুঝানোর প্রয়োজন হতোনা বা হয়নি। আর এ কারণেই হাদীস সমূহে ‘ক্রয়-বিক্রয়’ এর বিষয়টা যেভাবে আলোচিত হয়েছে, ‘সুদ’ এর বিষয়টা সেভাবে আসেনি। তবে তখনকার যুগে প্রচলিত ‘সুদ’ যেমন চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেযে একসময় দায়গ্রস্থ ব্যক্তিকে নিঃস্ব থেকে আরও নিঃস্ব করেছে; সেরকম আর্থিক লেন-দেন কিন্তু এখনো বিদ্যমান আছে। বর্তমান যুগেও সুদে গৃহীত টাকার ‘সুদ’ মাসে মাসে গ্রহণ করা হলেও আসল টাকা কিন্তু একযোগেই ফেরৎ দিতে হয়। ফলে ঋণ গ্রহীতার পক্ষে কোন ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়া গৃহীত টাকা ফেরৎ দেয়া সম্ভব না হওয়ায় তাকে নিঃস্ব থেকে আরো নিঃস্ব হতে হয়। কখনো বা কেউ কেউ দেনার দায়ভার বহন করতে না পারার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয় থাকেন।
মোদ্দাকথা, ‘সুদ’ এর দুইটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, (১) এটা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে (২) সুদে গৃহীত টাকা একযোগে ফেরৎ দেয়ার জন্য চরম মানসিক চাপ থাকে। ফলে ‘সুদ’ কখনোই মানুষের জন্য কল্যাণকর ছিল না এবং এখনো কল্যাণকর নয়। অনেকে ব্যাংক ও এনজিও এর কার্যক্রমকে ঢালাওভাবে ‘সুদ’ এর কারবার বলে থাকেন, যা কোনভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। একথা ঠিক যে, ব্যাংক ও এনজিও এর কার্যক্রমে যথেষ্ট ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, কিন্তু তাই বলে ঢালাওভাবে ঐসব কার্যক্রমকে ‘সুদ’ এর কারবার হিসেবে বিবেচনা না করে বরং মানব কল্যাণের স্বার্থে কুরআন ও হাদীসের আলোকে এসকল কর্মকান্ডের মাঝে কিছুটা সংযোজন-বিয়োজন করার মাধ্যমে এসব কার্যক্রমের গ্রহণযোগ্যতা সার্বজনীন করার চেষ্টা করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
নিচে অর্থনৈতিক লেন-দেন এর কয়েকটি ঘটনাপ্রবাহ উপস্থাপন করা হলো। খুব মনোযোগ সহকারে এগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, এগুলো ‘সুদ’ এর কোন সংজ্ঞা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যায় না। অন্যদিকে কখনো কখনো আমাদেরকে এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেই হয়।
ঘটনা প্রবাহ-১
মিঃ রহিম ঢাকায় তার ছেলের কাছে ১ লক্ষ টাকা পাঠাতে চান। জনাব করিম টাকাটা পৌঁছে দিতে চান তবে এজন্য তাকে ৫% খরচ প্রদান করতে হবে। মিঃ রহিম ভাবলেন, টাকাটা নিজে গিয়ে পৌঁছে দিতে গেলে তার পুরো দু’টো দিন মাটি হবে। তাছাড়া আজকাল নগদ টাকা নিয়ে চলাও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তার চেয়ে যদি ৫ হাজার টাকা খরচ দিয়ে ১ লক্ষ টাকা পৌছানো যায় সেটাই বরং ভাল। তাই মিঃ রহিম করিম কে ৫ হাজার টাকা খরচ দিয়ে তাকে ১ লক্ষ টাকা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিলেন।
- করিম মিঃ রহিমের নিকট থেকে যে ৫ হাজার টাকা নিলেন সেটা কি সুদ, মজুরী, নাকি সার্ভিস চার্জ না অন্য কিছু?
- প্রচলিত কোন সুদের সংজ্ঞা অনুযায়ী ঐ টাকা সুদ হতে পারে না। যদি মজুরী ধরা হয় আর ঢাকা যাওয়ার পথে ঐ টাকাটা কোনভাবে খোয়া যায় (হারানো/চুরি/ডাকাতি/ছিনতাই) তাহলে ঐ টাকার জন্য মজুরকে দায়ী করা যাবে কি?
- মিঃ রহিম ৫% খরচ দিতে রাজী নাহলে কি করিম ঝুঁকি নিয়ে মিঃ রহিমের টাকা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিতেন আর কেনই বা নেবেন?
- করিম ঝুঁকি নিয়েই টাকাটা পৌঁছানোর দায়িত্ব নিয়েছিল, কাজেই কোনভাবে টাকাটা খোয়া গেলে তার ক্ষতি পূরণ দিতে তিনি বাধ্য নয়কি?
- মিঃ রহিম নিজে টাকা নিয়ে গেলেও অনুরূপ ঘটনা ঘটতে পারতো তাতে হয়তো তার কিছুই করার নেই। কিন্তু করিমের কাছ থেকে টাকাটা খোয়া গেলে কেন তিনি তাকে ছেড়ে দেবেন?
ঘটনা প্রবাহ-২
জনাব রহিম আর্থিক স্বচ্ছলতা লাভের লক্ষ্যে মিঃ করিমের নিকট থেকে মূলধন নিয়ে ব্যবসা করতে চান। তিনি করিমকে প্রস্তাব দিলেন, আমাকে ব্যবসা করার জন্য ১ লক্ষ টাকা ধার (মূলধন) দিলে আমি আপনাকে ২০% মুনাফা সহ আমার ব্যবসায় অর্জিত আয় থেকে আপনাকে কিস্তিতে প্রদান করে এক বছরের মধ্যে পুরো টাকা পরিশোধ করবো। মিঃ করিম রহিমের প্রস্তাবে রাজী হয়ে তাকে ১ লক্ষ টাকা ধার দিলেন।
- জনাব রহিম কর্তৃক মিঃ করিমকে দেয়া অতিরিক্ত টাকাটা কি সুদ, নাকি মুনাফা না অন্য কিছু?
- যদি অতিরিক্ত টাকাটাকে সুদ/মুনাফা ধরা হয় তাহলে মিঃ করিম ধার দেয়া টাকা কেন কিস্তিতে ফেরৎ নেবেন?
- সুদ/মুনাফা যাই ধরা হোক, একযোগে ফেরৎ দিতে হলে তাকে ব্যবসা বন্ধ করে গৃহীত টাকা ফেরৎ দিতে হবে; তাতে জনাব রহিমের স্বচ্ছলতা আসবে কি?
- কিস্তিতে ঋণের টাকা পরিশোধের সুযোগ দেয়ার অর্থ হলো ঋণ গ্রহীতাকে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করা, ঋণের ভাড়ে তাকে পথে বসানো নয়। প্রচলিত সুদের ক্ষেত্রে এ সুযোগ আছে কি?
ঘটনা প্রবাহ-৩
কম মূল্যে পণ্য কিনে বেশী মূল্যে বিক্রি করাই হলো ব্যবসা। কিন্তু টাকা কি কোন পণ্য হতে পারে? যদি না পারে তাহলে ডলার(ভিন দেশী যেকোন মুদ্রা) আর টাকা কিভাবে বিনিময় হবে? টাকা ও ডলার বিনিময় কি ব্যবসা নয়? যে কেউ টাকা দিয়ে ডলার কিনে রাখতেই পারে ভবিষ্যতে বেশী দামে বিক্রি করার জন্য, এটা কি ব্যবসা নয়? যদি বলা হয় ভিন দেশের মুদ্রা পণ্য হিসেবে কেনা-বেচা করা যাবে তাহলে রহিম মিয়ার বহুদিন ধরে জমানো খুচরা পয়সাগুলোর কী হবে যেগুলো তিনি জমিয়েছেন একখন্ড জমি কেনার জন্য? বহুদিন ধরে একটু একটু করে তিনি ১ লক্ষ টাকা জমা করেছেন কিন্তু কোন জমি বিক্রেতাই খুচরা পয়সা নিতে রাজী নয়। সমস্যাটি সমাধানে করিম মিয়া রহিম মিয়াকে ১ লক্ষ টাকার বিপরীতে ৯০ হাজার টাকা দেয়ার প্রস্তাব দিলে রহিম মিয়া খুশি হয়ে ১ লক্ষ টাকার খুচরা পয়সা দিয়ে করিমের কাছ থেকে ৯০ হাজার টাকা গ্রহণ করে।
- করিম মিয়ার অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা গ্রহণ কি সুদ না অন্য কিছু?
- যদি করিম মিয়ার অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা নেয়া অন্যায় হয়ে থাকে তাহলে খুচরা পয়সা নিয়ে রহিম মিয়া যে সমস্যায় পড়েছেন, করিম মিয়া কেন সেই সমস্যা স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নেবেন?
- টাকা দ্বারা কেবলমাত্র পণ্য কেনা-বেচাই হয়না বরং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে মানুষ টাকা হাত বদল করে। টাকা হাত বদল করে প্রদত্ত টাকার অতিরিক্ত নিলেই কি তা সুদ হবে?
- ব্যবসার জন্য ১ লক্ষ টাকা ধার দিয়ে অর্জিত আয় থেকে অল্প অল্প করে (কিস্তিতে) পরিশোধের সুযোগ দেয়া আর টাকা দিয়ে খুচরা পয়সা নেয়া দুটোই সমান কথা নয়কি?
কাজেই শুধুমাত্র ইসলামের অনুসারীদেরই নয়, বরং মানব কল্যাণের স্বার্থে সকলেরই উচিৎ ‘সুদ’ থেকে দূরে থাকা। আর যে সকল আর্থিক কর্মকান্ড ‘সুদ’ এর স্বরূপের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় সেসকল কর্মকান্ডের বিষয়ে সমাজে ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকা।