আউটসোর্সিং বনাম কৃষি ও অন্যান্য ব্যবসা

প্রবাদ আছে, “ভাত ছিটালে কাক এর অভাব হয় না”। কিন্তু সময়টা এখন অনেকটা বদলে গেছে, তাই এই প্রবাদ বাক্যটি এখন সংশোধন করে বরং বলা যেতে পারে, “দক্ষতা থাকলে কাজ এর অভাব হয় না”। আবার বলা হয়ে থাকে, “এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার সময় এসেছে তার” এটাকে বদলে বরং বলা যেতে পারে, “তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতা আছে যার, গড়বেই তো সে টাকার পাহাড়”।

হ্যাঁ, বলছিলাম আউটসোর্সিং এর কথা। খুব কম সময়ের মধ্যে আউটসোর্সিং এর হাওয়াটা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে অতি দ্রুত। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমি দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এটাই বলবো যে, বাংলাদেশের যতজন লোক আউটসোর্সিং শব্দটার সাথে পরিচিত তাদের মধ্যে শতকরা ৫% লোকও জানেন না আউটসোর্সিং জিনিসটা আসলে কী। আবার কেউ কেউ জানলেও এটাকে বিশ্বাস করেন না, মানে এটা যে একটা পেশা হতে পারে বা এর মাধ্যমে একজন শিক্ষিত ছেলে/মেয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এটা যেন বিশ্বাস করাই কঠিন।

একটা কম্পিউটার প্রশিক্ষন কেন্দ্র থাকার সুবাদে বলতে গেলে গাইবান্ধা জেলার সকল কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সহ দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথেই আমার পরিচয় ও যোগাযোগ আছে। কিন্তু গাইবান্ধা জেলার যেসব কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিয়ে শিক্ষার্থীরা একটা সরকারী সনদ মানে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে সনদপত্র প্রাপ্ত হন সেসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আমি একটিও খুঁজে পাইনি যেখানে বা যারা আউটসোর্সিং নিয়ে ভাবেন বা আউটসোর্সিং নিয়ে কিছু করতে চান। প্রকৃতপক্ষে তারাই আউটসোর্সিং সম্পর্কে ভাল জানেন না বা জানলেও এটাকে অনেকেই বিশ্বাস করেন না। বরং আমি অনেক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের সাথে এ বিষয়ে কথা বলায় উত্তর পেয়েছি, “ধ্যাৎ, আউটসোর্সিং একটা স্বপ্ন, এটা আমাদের জন্য নয়”। এই যদি হয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অবস্থা তাহলে একবার ভেবে দেখুনতো, একজন সাধারণ মানুষ আউটসোর্সিং সম্পর্কে আসলে কতটা জানেন।

প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের বদৌলতে আমার কাছে অনেকেই আসে আউটসোর্সিং সম্পর্কে জানতে বা আউটসোর্সিং এর কোর্স করার আগ্রহ নিয়ে। যখন তার কাছে জানতে চাই কম্পিউটার বিষয়ে তার কোন প্রশিক্ষণ নেয়া আছে কি না বা কম্পিউটারের মাধ্যমে সে কী কী কাজ করতে পারে, আর তার উত্তর হয় ‘না’ অর্থাৎ কম্পিউটারের প্রাথমিক ব্যবহারটুকুও তিনি জানেন না তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, আসলে সে কি বুঝেই আউটসোর্সিং এর কোর্স করার কথা বলছে, নাকি এর নাম ‘হুজুকে বাঙালী’। সবচেয়ে বেশী অবাক লাগে, যখন দেখি ৭ম বা ৮ম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থী আউটসোর্সিং এর কোর্স করতে চায়।

জমিতে ধানের বীজ বপন করলে বীজ থেকে চারা হবে, চারা থেকে ধানগাছ/ধান হবে, ধান থেকে চাল হবে, চাল থেকে ভাত হবে এটা অবশ্যই সত্য। কিন্তু ধানের বীজ বপন করার কৌশল শিখতে যাওয়া কোন ব্যক্তি যদি বলেন, ভাত রান্না করা শিখছি তাহলে কি তা অস্বাভাবিক নয়?

সুতরাং আউটসোর্সিং এর কোর্স করা আর কম্পিউটারের মাধ্যমে কোন কাজ শেখা বা দক্ষতা উন্নয়নমূলক কোন কোর্স করা কখনোই এক হতে পারে না। অর্থাৎ আউটসোর্সিং করতে হলে আগে অবশ্যই আপনাকে কোন না কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে, তারপর ভাবা যাবে আউটসোর্সিং করতে পারবেন কি পারবেন না। সুতরাং কোন কাজ না শিখে আউটসোর্সিং করার কথা ভাবা মানে এটা একটা মানসিক রোগ অথবা অজ্ঞতা।

এবার কাজের কথায় আসা যাক, যে বাবা-মা ২৪/২৫ বছর ধরে সন্তানের লেখাপড়ার পিছনে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীটি অর্জন করালেন, সে বাবা-মা কি নিশ্চিত, তার সন্তান পাশ করে এসে একটা চাকরি পাবে এবং সংসারের হাল ধরবে। অবশ্যই হ্যাঁ বলার কোন সুযোগ নেই, কারণ এদেশে এখনো হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া শেষ করে বেকার জীবনযাপন করছে। যেখানে ২৫ বছর ধরে লেখাপড়ার পিছনে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে লেখাপড়া শেষে চাকুরি পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা নেই সেখানে কোন কাজ না শিখে কেবলমাত্র ১/২ মাসের একটা প্রশিক্ষণ নিয়ে লক্ষ লক্ষ ডলার উপার্জন করবেন এটা ভাবা দিবা স্বপ্ন নয় কি?

আমার এ লেখাটির শিরোনাম, ‘আউটসোর্সিং বনাম কৃষি ও অন্যান্য ব্যবসা’। একবার ভাবুন তো একজন কৃষক ২৪ ঘন্টার মধ্যে কত ঘন্টা পরিশ্রম করেন? অবশ্যই ঘুমের সময়টুকু ব্যতীত পুরোটাই পরিশ্রম। আর এই পুরো সময়টা ধরে তিনি কাজ করেন কখনো ধানের জমিতে, কখনো পাটের ক্ষেতে, কখনো বা পিঁয়াজ-মরিচ বা আলুর জমিতে। অর্থাৎ প্রত্যেক কৃষকই বিভিন্ন জমিতে নানা ধরণের ফসল উৎপাদন করে লাভবান হতে চেষ্টা করেন। ফসল কাটার পর দেখা যায় কোন জমি থেকে তিনি তার পারিশ্রমিক ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে বেশ লাভবান হয়েছেন, কোন জমি থেকে হয়তো কেবলমাত্র খরচটা উঠে এসেছে আবার কোন জমিতে হয়তো লোকসানও গুনেছেন। কিন্তু সব কৃষকই এমনটাই করে থাকেন। এমন কোন কৃষক খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি তার সকল জমিতে সারা বছর ধরে একই ফসলের চাষ করেন। মনীষীদের কথায়, “তোমার যদি ১০টা ডিম থাকে তাহলে তা দু’ভাগ করে দু’টো ঝুড়িতে রেখে দাও”। কেননা, তাতে ক্ষতির সম্ভাবনা অনেক কম থাকবে।

এবার আসা যাক দোকানীর কাছে। সারাদিন তিনি তার দোকানে ছোট বড় মিলিয়ে কত কিছুই না বিক্রয় করেন। এমনকি ৫০ পয়সা বা ১ টাকা মূল্যমানের দ্রব্যও তাকে বিক্রয় করতে হয়। একবার ভাবুনতো একজন দোকানী ১ টাকার একটি পণ্য বিক্রি করে কত মুনাফা করবেন? নিশ্চয় ১০ বা ১৫ পয়সার বেশী নয় মানে শতকরা হিসেবে ১০% বা ১৫% মুনাফা করবেন। আমি একদিন কোন এক দোকানীর কাছে শুনেছিলাম, ২ লিটার সয়াবিন তেল তিনি পাইকারী মূল্য ২০০ টাকায় কেনেন আর বিক্রি করেন ২০৫ টাকা অর্থাৎ, শতকরা ২½ % মুনাফায়। একবার ভেবে দেখেছেন কি দোকানীকে সংসার চালানোর জন্য তার ব্যবসায় কত টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে, সারাদিন তিনি কত জিনিসপত্রই না বিক্রি করেন যার কোনটি বিক্রি করে লাভ হয়, কোনটিতে আসল আর কোনটিতে লোকসান গুনতে হয়। মানে কৃষি, ব্যবসা যেটাই বলুন না কেন, টাকা উপার্জন করাটা আসলে কিন্তু ততটা সহজ নয়। তাই হয়তো ভাবছেন, কৃষি, ব্যবসা বাণিজ্যের চেয়ে আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে টাকা উপার্জন করা সহজ। কিন্তু ভুলে যাবেন না, আউটসোর্সিং হলো সহজ উপায়ে টাকা উপার্জনের একটি কঠিন মাধ্যম যেখানে অগ্রাধিকার পাবে দক্ষতা, দক্ষতা এবং দক্ষতা। দক্ষতা ব্যতীত আউটসোর্সিং জগতে আপনি মূল্যহীন।

এবার আসা যাক চাকরির বাজারে। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে সম্ভবত ১৯৯৬ সালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালীন আমার এক জুনিয়র ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল যিনি তখন গণিত বিষয়ে সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, আর ভাল লাগে না, মাস্টার্সটা কমপ্লিট করেই একটা কলেজে ঢুকে যাব। আমি বললাম, কলেজে ঢুকবো বললেই কি ঢোকা যায়? উত্তরে বলল, টাকা হলে এখন বাঘের চোখও মিলে। নাহয় ১৫/২০ লাখ টাকা লাগবে, তাও দেব। তার ঐ কথা শুনে আমি হতবাক, বললাম, গণিত বিষয়ে লেখাপড়া করে আজকাল চাকরি না করেও কেবলমাত্র প্রাইভেট পড়িয়েই মাসে ২৫/৩০ হাজার টাকা উপার্জন করা যায় আর আপনি কি না ………. ।

কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকার সুবাদে এখানে নানা ধরণের শিক্ষার্থী ও ব্যক্তির আগমন ঘটে। অনেকের মুখে টাকা দিয়ে চাকরি নেয়ার কথাও শুনি। একদিন এক চাকরি প্রার্থী ইন্টারনেটে চাকরির পরীক্ষার ফলাফলে তার নাম দেখতে না পেয়ে বলল, চাকরিটার জন্য ১০ লাখ টাকা কন্ট্রাক্ট করেছি, ৪ লাখ টাকা অগ্রীমও দিয়েছি অথচ ফলাফলে আমার রোল নম্বর নাই, টাকা ফেরৎ না দিলে খুন করে ফেলবো। আমার অন্য এক ছাত্রের মুখে শুনেছিলাম, স্যার, সরকারী চাকুরি হলে আমি ২০ লক্ষ টাকা দিতেও প্রস্তুত।

গাইবান্ধার কোন এক কলেজে নাকি একজন প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৩৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে। কোন এক দাখিল মাদ্রাসায় একজন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১৪ লক্ষ টাকার বিনিময়ে। ঐ শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আচ্ছা আপনি ১৪ লক্ষ টাকার বিনিময়ে একজন সহকারী শিক্ষক এর পদে ঢুকলেন, বেতন পাবেন কয় টাকা? তার সোজা সাপটা উত্তর, বেতন যাইহোক, মানুষতো বলবে আমি চাকুরী করি। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এমপিওভূক্ত হয়নি এমন প্রতিষ্ঠানে ঢুকে বিগত ১৫ বছর ধরে ভুতের বেগার খাটছেন এমন অনেককেই আমি চিনি। শুধু গাইবান্ধা নয় বরং গোটা বাংলাদেশেরই এই একই চিত্র্। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমাদের দেশের চাকরির অবস্থাটা কী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন এই টাকা দিয়ে চাকরি কেনার প্রতিযোগিতা চলছে? অনেকেই হয়তো বলবেন, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব অর্থাৎ চাকরির পদের চেয়ে চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা বেশী তাই। অনেকে হয়তো এটাও বলতে পারেন, আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে পুনর্বাসন করা গেলে হয়তো সমস্যাটা সমাধান হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যারা টাকা দিয়ে চাকরি খরিদ করে বা করতে চায় তাদের দ্বারা আর যাই কিছু হোক আউটসোর্সিং সম্ভব নয়। কেননা, আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে কাউকে পুনর্বাসন করা যায় না, বরং দক্ষতা থাকলে আউটসোর্সিং নিজেই তাকে খুঁজে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করবে।

আমার এ লেখাটা মূলতঃ তাদের জন্য যারা দীর্ঘদিন ধরে মার্কেটপ্লেসে বিড করে করে অবশেষে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ইচ্ছে করলে তারা আবারও আউটসোর্সিং বিষয়টা নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারেন। আর যারা জমি জিরাত বিক্রি করে একটা চাকরি কেনার জন্য টাকা-পয়সা জোগাড় করে অপেক্ষা করছেন তাদেরকে বলবো, চাকরি কেনার ধান্দাটা বরং মাথা থেকে ডিলিট করে টাকাটা কোন এক ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখে দিন, মাস গেলে মুনাফাটা তুলে খরচ করতে পারবেন। আর পরিচয়ের কথা ভাবছেন তো, টাকাটা ব্যাংকে জমা করার আগে তার থেকে সামান্য কিছু নিয়ে একটা কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে নিন। সেই সাথে ভাল কোন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে আউটসোর্সিং করা যায় এমন কোন একটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিন। মনে রাখবেন, প্রশিক্ষণ নেয়া শেষ মানে কিন্তু উপার্জন শুরু নয়। আপনাকে আউটসোর্সিং করে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে আরো লম্বা একটি পথ অতিক্রম করতে হবে। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই কেননা, লক্ষ্য ঠিক থাকলে নিশ্চিত আপনি গন্তব্য স্থলে পৌঁছে যাবেন (ইনশাল্লাহ)। আর শ্বশুর-শাশুরীর কাছে লোকজন যদি জানতে চায় জামাই কী করেন, তাহলে তারাও বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন আমাদের জামাই একজন ফ্রীল্যান্সার মানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে টাকা উপার্জন করেন।

জীবনের ২৫টি বছর লেখাপড়ার পিছনে ব্যয় করলেন, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করলেন অথচ চাকরি নাই, বেকার বসে আছেন এটা যদি সহ্য হয় তাহলে সামান্য কয়টি টাকা খরচ করে প্রশিক্ষণ নিতে দোষ কী? ভাগ্যচক্রে যদি এরই মধ্যে একটা চাকরি জুটেই যায় ক্ষতি কী? প্রশিক্ষণটা আপনার চাকরিক্ষেত্রেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এখনতো প্রায় সকল চাকরির বিজ্ঞাপনেই দেখা যায়, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ থাকতে হবে কিংবা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ থাকলে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।

পিতা-মাতাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাই। আপনারা যদি সম্ভাব্য পিতা-মাতা হয়ে থাকেন তাহলে কিছু টাকা এখনই জমিয়ে রাখুন, সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর একটা কম্পিউটার কিনবেন সন্তানের খেলনা মনে করে। আর যারা পিতা-মাতা হয়েছেন, সন্তান ছোট তারা এখনই অন্য সব খেলনা কেনা বন্ধ করে দিয়ে সন্তানকে খেলনা হিসেবে একটা কম্পিউটার কিনে দিন দেখবেন আপনার সন্তান স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই খেলতে খেলতে যা শিখেছে তা আপনি কখনো কল্পনাও করেননি। আর যাদের সন্তান স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করছে দেরী না করে তাদের জন্য একটা কম্পিউটারের ব্যবস্থা করে দিন সাথে একটা ইন্টারনেট সংযোগ, আশা করা যায় ঠকবেন না। মনে রাখবেন, লেখাপড়ার উদ্দেশ্য কেবল সার্টিফিকেট অর্জন নয়, জ্ঞানার্জনও বটে। একজন শিক্ষার্থী ৫ জন প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়ে যে জ্ঞানার্জন করবেন তার চেয়ে অনেক গুণ বেশী জ্ঞানার্জন করতে পারবে যদি ইন্টারনেট সংযোগ সহ বাসায় একটি কম্পিউটার থাকে। একজন প্রাইভেট শিক্ষকের লক্ষ্য কেবল বিদ্যালয়ের সিলেবাস মানে শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করলেই তো তার ডিমান্ড বাড়বে। আর বাসায় কম্পিউটার থাকলে শিক্ষক ছাড়াই একজন শিক্ষার্থী যা শিখবে তা কোন সিলেবাস দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। মনে রাখবেন, বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় মাষ্টার হলো ইন্টারনেট সংযোগসহ একটা কম্পিউটার। বাসায় একটা কম্পিউটার কিনলে এটা কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছু দেবে না। কিছু নেতিবাচক বিষয় থাকলেও সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং ইতিবাচক দিকগুলোকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। কারণ একটু সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলেই দেখবেন কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যবহারে কুফলের তুলনায় সুফলের পরিমাণটা অনেক অনেক গুণ বেশী।

আর যেসব বাবা-মা সন্তানের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই টাকার পোটলা নিয়ে কোচিং সেন্টারে দৌড়ান সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং করাবেন বলে, তাদেরকে বলবো, বর্তমান সময়ে সন্তানের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং এর পিছনে আপনি যে টাকা ব্যয় করেন, তার ৩০% টাকাও লাগবে না একটা কম্পিউটার/ল্যাপটপ কিনতে। আপনার সন্তান উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্বে যে অবসর সময়টুকু পায়, তা কাজে লাগানোর জন্য তাকে একটা কম্পিউটার/ল্যাপটপ আর একটা ইন্টারনেট সংযোগ(মডেম) কিনে দিন। যদি আপনার সন্তান প্রকৃতপক্ষে জ্ঞান পিপাসূ হয় বা মেধাবী হয় তাহলে আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনার সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। আর যদি আপনার সন্তান জ্ঞান পিপাসূ না হয়ে বরং অনূকরণ প্রিয় (বানরের স্বভাব) হয়ে থাকে তাহলে যদি আপনি আপানার সন্তানকে দেশের সেরা কোচিং সেন্টারেও ভর্তি করান তাহলে আপনার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে, অন্তত আমি এটা বিশ্বাস করি না। বরং আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে যদি সকল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলেও কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বন্ধ থাকবে না বা আসনও ফাঁকা থাকবে না। প্রকৃতপক্ষে যেসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করে ভর্তি হয় তারা তাদের নিজ যোগ্যতাতেই হয়, এখানে কোচিং সেন্টার একটা গৌণ ভূমিকা পালন করে মাত্র। বাংলাদেশে এমন কোন কোচিং সেন্টার খুঁজে পাওয়া যাবে কি যেখানে কোচিং করার পর সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে? যদি এই প্রশ্নের উত্তর ‘না’ হয় তাহলে অবশ্যই বলতে হবে কেবলমাত্র যোগ্যরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়, সকলে নয়। আর যারা যোগ্য তাদের সেই যোগ্যতা ৩/৪ মাসের মধ্যে কোচিং করার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে একথা কেবল একজন মূর্খ বা গোয়াড়ের পক্ষেই বিশ্বাস করা সম্ভব।

আমাদের দেশে একজন শিক্ষার্থী কতটা মেধাবী তা নির্ণয় করা হয় প্রাপ্ত জিপিএ বা ডিভিশন দ্বারা। একথা ঠিক, মেধা যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষার কোন বিকল্প নাই। কিন্তু সেইসাথে এটাও ঠিক যে, কেবলমাত্র গদবাধা গুটি কয়েক প্রশ্নের সঠিক উত্তর পরীক্ষার খাতায় লিখে জিপিএ ৫.০০ অর্জন করা মানেই সে একজন সেরা ছাত্র/ছাত্রী একথা বলারও কোন সুযোগ নেই। কেননা, প্রকৃত মেধা যাচাই করার জন্য প্রয়োজন অভিযোজন ক্ষমতা যাচাই করা। একই সাথে একই কোচিং সেন্টারে কোচিং করে জিপিএ ৫.০০ পাওয়া সব শিক্ষার্থী যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়না তেমনি জিপিএ ৫.০০ না পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সকল শিক্ষার্থীই কোচিং করেছে এমনটাও কিন্তু সঠিক নয়। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কিছুটা হলেও শিক্ষার্থীদের অভিযোজন ক্ষমতা যাচাইযের কম-বেশী সুযোগ ঘটে তাই যোগ্যরাই এখানে ভর্তির সুযোগ পায়। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোচিং সেন্টার একটা গুরু দায়িত্ব পালন করে এটা ভাবা অবান্তর। তাই বলছিলাম, আপনার সন্তানকে কোচিং এর প্রতি আগ্রহী না করে বরং কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট এর প্রতি আগ্রহী করুন, দেখবেন আপনি সন্তান এর কাছ থেকে যতটুকু আশা করেছিলেন তার থেকে একটু বেশীই পাবেন।

অনেকেই হইতো বলবেন, ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গেলে তো মাসে মাসে একটা বাড়তি ব্যয় হবে। তাদেরকে বলবো, আপনি সন্তানের প্রাইভেট/কোচিং এর পিছনে এত টাকা ব্যয় করেন আর সন্তান এর ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য ইন্টারনেট খরচ বাবদ সামান্য কয়েকটা টাকা ব্যয় করতে পারবেন না। আর আপনার যে সন্তানটি ছাত্র জীবন থেকেই ধূমপানে অভ্যস্ত ভেবে দেখেছেন কি, আপনার সন্তান কেবলমাত্র ধূমপান এর পিছনে মাসে কত টাকা ব্যয় করে? আমি এমন অনেক শিক্ষার্থীকেই দেখেছি, বেনসন সিগারেট টানতে (বর্তমানে প্রতি শলাকার মূল্য ১১ টাকা)। যদি সে এর থেকে কম মূল্যের যেমন গোল্ডলীপ (বর্তমানে প্রতি শলাকার মূল্য ৮ টাকা) সিগারেটও টানেন তাহলে দৈনিক গড়ে ১৫টা সিগারেট টানলে তার সিগারেট এর পিছনে মাসে ব্যয় হবে (১৫ × ৮ × ৩০) = ৩৬০০/- টাকা (বাপরে বাপ!!!)। অথচ পুরো মাস জুড়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও মাসে তার ৬০০/- টাকাও ব্যয় হবে না।

হায়রে! মূর্খ আমরা, ধূমপানের পিছনে মাসে ৩৬০০/- টাকা ব্যয় করলে আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছাড়া আর কিছুই বাড়বে না, অথচ মাসে ৬০০/- টাকা ইন্টারনেট এর পিছনে ব্যয় করলে বাড়বে শুধু জ্ঞান, জ্ঞান আর জ্ঞান। একেই কি বলে, “হীরা ফেলে কাঁচ তুলে নেয়া?” নাকি এর নাম, “জেনে-বুঝে বিষ পান করা”।

ধূমপান একটা কালচার, আর যারা ধূমপান করে তাদের বেশীর ভাগই অন্যের দেখা-দেখী এই কালচারে অভ্যস্ত হয়। অনেকে আবার শখ এর বসবতি হয়ে এই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। যে যেভাবেই অভ্যস্ত হোক না কেন, চাইলেই যখন-তখন এই নেশা ছেড়ে দেয়া সম্ভব অবশ্য কেউ যদি মনে প্রানে নেশা ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা পোষন করেন। তো যাইহোক, আপনি ধূমপান ছাড়ুন আর না ছাড়ুন, সিগারেট এর পেছনে মাসে ৩৬০০/- টাকা ব্যয় করুন বা ৭২০০/- টাকা ব্যয় করুন তা আপনার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। আমি বলছি, এর সাথে আর সামান্য কয়েকটা টাকা ইন্টারনেট এর জন্য ব্যয় করতে কেননা, এই বাড়তি কয়েকটা টাকা আপনাকে ভাল ব্যতিত খারাপ কিছুই দেবে না।

বাড়িতে একটি কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে কিভাবে আপনার সন্তান উপকৃত হবে নিচে সেবিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা হলো-
১. সন্তান যদি কেবলমাত্র বসে থাকতে পারে তাহলে তাকে কম্পিউটারের মাউসটা ধরিয়ে দিন। প্লাস্টিক বা কাঠের খেলনা কিনে না দিয়ে তাকে কম্পিউটারের মাউস নিয়ে খেলতে দিন। আর একটু বড় হলে অ, আ, ক, খ, A, B, C, D, ث ت ب ا ১, ২, ৩ শেখা যায় এমন কিছু ডিজিটাল বই মানে CD/DVD কিনে দিন। কোন শিক্ষক দরকার হবে না, আপনি আন্তরিক হলে ৬ মাস পর দেখবেন ইতোমধ্যে আপনার সন্তান কেবল অক্ষরই চিনেনি বরং বেশ কিছু ছড়াও মুখস্থ করে ফেলেছে, এমনকি নামতাও শিখে ফেলতে পারে। অবাক হওয়ার কিছু নেই একজন বাচ্চার শিক্ষাজীবনের শুরুতে যা যা শেখা উচিৎ তার সবগুলোই এখন কম্পিউটারের মাধ্যমে শিক্ষক ছাড়াই বাচ্চাদের পক্ষে একা একা শেখা সম্ভব প্রয়োজন কেবল উপযুক্ত পরিবেশ।

২. আপনার সন্তান যদি বিদ্যালয়গামী হয় তাহলে এখনই একটা কম্পিউটার কিনে দিন। একটা কম্পিউটার তার জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রটা এতটাই প্রসারিত করবে যে, তা গতানুগতিক পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে কল্পনাও করা যায় না। আপনার বা আপনার সন্তানের কাছে এমন কোন প্রশ্ন নেই যার উত্তর গুগলের জানা নেই। মনে রাখবেন, Google is the Head all of the headmasters over the world. আপনি কি পৃথীবির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চান, নাকি বোম্বের কোন নায়ক নায়িকা সম্পর্কে, যাইহোক গুগলকে প্রশ্ন করে দেখতে পারেন। শুধু কি তাই, ইসলামী শরীয়া অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কে, কতটুকু পাবেন তার হিসেব জানার জন্য উকিল সাহেবের বাড়িতে গিয়ে কয়েক ঘন্টা অপেক্ষার পর একটা মোটা টাকা বিল হিসেবে দিয়ে আসতে হয়। একবার দেখুন না চেষ্টা করে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে দু’ মিনিটের মধ্যে সঠিক হিসাবটা পান কি না। এমনকি কোন শিক্ষক ছাড়াই বাংলা, ইংরেজী, আরবী, ফাসী সহ বিভিন্ন ভাষা শিখতে পারেন নিজে নিজেই।

৩. আপনার ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া সন্তান যদি সত্যিকার অর্থেই মেধাবী হয় এবং তার কাছে যদি একটি ল্যাপটপ থাকে, তাহলে আমার বিশ্বাস ওর বাকী লেখাপড়ার খরচটুকু আপনাকে আর জোগাতে হবে না, অবশ্য সন্তান যদি মেধাবী না হয়ে ভাগ্যের জোড়ে ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়ে থাকেন সেটা আলাদা কথা।

এবার আসি বিনোদনের কথায়। বিনোদনের এমন কোন বিষয় নেই যা কম্পিউটারের মাধ্যমে পাওয়া যায় না। গান শোনা, ভিডিও দেখা, টিভি দেখা, দুরের কোন ব্যক্তির সাথে কথা বলা (ফোন ছাড়াই), চ্যাটিং করা ইত্যাদি। আর মন চাইলে গুগল ম্যাপ এর সাহায্যে গোটা বিশ্ব ভ্রমণ করতে পারেন ঘরে বসেই। মাইরি বলছি, আপনি চাইলে আপনার বাড়ীটা পৃথীবির ঠিক কোন জায়গায় অবস্থিত তাও খুঁজে বের করতে পারবেন গুগল ম্যাপ এর মাধ্যমে, কী মজার তাই না? অবশ্য তাদের জন্য যারা জ্ঞান পিপাসু। আমাদের দেশে অবশ্য খুব কম মানুষই পিপাসার জন্য জ্ঞান অন্বেষণ করেন বরং এ দেশের বেশীর ভাগ শিক্ষার্থীই জ্ঞান অন্বেষণ করেন না বরং পড়ালেখা করে কিভাবে একটা ভাল মানের সনদপত্র পাওয়া যায় তার জন্য উঠে পড়ে লাগেন; অথচ, পড়ালেখা করার মূল উদ্দেশ্যই হলো জ্ঞান অন্বেষণ করা। মনীষীদের কথায়, “Seek knowledge from cradle to the grave (দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ কর)”। ধর্মের শিক্ষাও তাই, “জ্ঞান অর্জনের জন্য দরকার হলে চীন দেশে যাও”। আল কোরআন এর প্রথম আয়াত ‘ইকরা’ অর্থাৎ পড়। এই পড়ার মানে কিন্তু দেখে দেখে মুখস্থ করা নয় বরং এই পড়ার মানে হলো জ্ঞান অন্বেষণ করা। প্রিয়নবীর(সঃ) এর বানী , “তালাবুল ইলমে ফার-ই-দাতুন, আলা কুল্লি মিুসলিমিন ওয়াল মুসলিমাতে” অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ মানে অবশ্য কর্তব্য। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, বাসায় একটি কম্পিউটার থাকা মানে তার উপকারিতা পরিমাপ করা যাবে না।

অনেকেই বলে থাকেন, অল্প বয়সে বাচ্চাদের হাতে কম্পিউটার তুলে দিলে বাচ্চারা লেখাপড়া বাদ দিয়ে সারাদিন কম্পিউটারে গেম খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, ফলে লেখাপড়া গোল্লায় যাবে। ভুল, বিশ্বের লক্ষ লক্ষ শিশুর উপর জরীপ চালিয়ে দেখা গেছে যেসব শিশু কম্পিউটারে গেম খেলে তারা অন্যদের তুলনায় বেশী মেধাবী হয় এবং বিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফলও অন্যান্যদের তুলনায় ভাল।

অনেকেই হয়তো আমার সন্তানের বিষয়ে জানতে চাইবেন তাই আগেই বলে রাখি। আল্লাহপাক আমাকে কেবলমাত্র একটি পুত্র সন্তান দান করেছেন যে কিনা এবার (২০১৭) পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। প্লে থেকে পঞ্চম শ্রেণী অর্থাৎ অদ্যাবধি বিদ্যালয় ব্যতীত ওকে অতিরিক্ত কোন কোচিং বা প্রাইভেট শিক্ষক দিতে হয়নি। আর পরীক্ষার ফলাফলের কথা জানতে চাইবেন তো, চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত সকল শ্রেণীতে সকল বিষয়ে মা-শাল্লাহ ১০০, ৯৯, ৯৮, ৯৭ এর নিচে কখনো নম্বর পায়নি। ইনশাল্লাহ, সমাপনী পরীক্ষাতেও ও ভালই করবে আর পিতা হিসাবে আমি আমার সন্তানের জন্য এটাই প্রার্থনা করি। সারাদিনের লেখাপড়ার কথা জানতে চাইবেন তো, বিদ্যালয়ের বাইরে যেটুকু সময় পায় তার মধ্যে কমপক্ষে ৬ ঘন্টা ঘুম, লেখাপড়ায় ব্যয় করে অনুর্ধ ২ ঘন্টা আর বাকী সময়টা কম্পিউটার নিয়েই থাকে। আর মন ভাল থাকলে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায়ের চেষ্টাটুকুও করে। পিতা হিসেবে আমি সন্তানকে নিয়ে মোটেও উদবিগ্ন নই বরং গর্ববোধ করি যখন দেখি আমার সন্তান কম্পিউটারের মাধ্যমে এমন কিছু শিখেছে যা আমি নিজেই জানিনা।

আমার সন্তানকে আমি কোন কোচিং বা প্রাইভেট শিক্ষক দেইনি বরং সন্তানের জন্য মাসিক ইন্টারনেট খরচ বাবদ ১০০০/-(এক হাজার) টাকা বরাদ্দ করা আছে। আমার সন্তানের একটাই নেশা তা হলো ডাউনলোড। প্রতিদিন আমার ছেলেটা কী যে এত ডাউনলোড করে বুঝতেই পারি না। গেম, কার্টুন, ভিডিও, অডিও যাই বলুন না কেন, পিতা হিসাবে আমি বলবো ডাউনলোডের ক্ষেত্রে আমার সন্তানের কোন জুড়ি নেই। ইন্টারনেটে গেম খেলা বা কম্পিউটারে কোন সফটওয়্যার ইন্সটল করা তো সাধারণ বেপার মাত্র। ও যখন দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী তখনই শিখে ফেলেছে কিভাবে কম্পিউটারে অপারেটিং সিস্টেম ইন্সটল করতে হয়। আর তৃতীয় শ্রেণীতে ওঠার পর থেকে তো ওর বন্ধুরাও ওর কাছ থেকে কম্পিউটারে অপারেটিং সিস্টেম ইন্সটল করে নিয়ে থাকে।

আমি জানিনা, আমার ছেলে সফটওয়ার বলতে আসলে কী বোঝে? তবে ওর কাছে যখন আরো ছোট থাকতে জিজ্ঞাসা করতাম, বাবা বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও, উত্তরে বলতো, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। শুনে অবাক হতাম, এইটুকুন বাচ্চা সফটওয়্যার বা ইঞ্জিনিয়ারের কী বোঝে? এখনো প্রশ্ন করলে ঐ একই উত্তর। জানিনা, মহান আল্লাহ-তা-আলা ওর জন্য কী বরাদ্দ করে রেখেছেন তবে পিতা হিসাবে আমি মহান আল্লাহর নিকট এই প্রার্থনাই করবো তিনি যেন তার বৈধ চাওয়াগুলোকে পূর্ণ করে দেন। সব পিতা-মাতাই চায় সন্তান বড় হয়ে মানুষের মত মানুষ হবে, পিতা-মাতার মুখ উজ্জল করবে তাহলে আমিই বা তা থেকে আলাদা হই কী করে? তবে বিশ্বাস করি মানুষ যা চায় তাই পায় যদি যিনি দেন তার কাছে অন্তর থেকে চাওয়া হয় এবং চাওয়াকে পাওয়ায় পরিণত করার জন্য প্রয়োজনীয় চেষ্টা করেন।

আবারও ফিরতে চাই আউটসোর্সিং এর জগতে। বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ আর ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে নানা রকম প্রচারণা ও বহুমূখী প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে চেষ্টা করে যাচ্ছেন যাতে আউটসোর্সিং ক্ষেত্রটা হয় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান মাধ্যম। সরকারের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমটা আরো অধিকতর সফল হতে পারতো যদি প্রশিক্ষণ নেয়ার পর প্রশিক্ষনার্থীরা খুব সহজেই ন্যূনতম উপার্জনের একটা উৎস খুঁজে পেত। অবশ্য সরকার চাইলে দৃষ্টিশক্তি আরো একটু প্রসারিত করে প্রকল্পগুলো মডিফিকেশন ও বাস্তবায়ন করতে পারে। যেমন- ‘বিল্যান্সার’ কে পৃষ্টপোষকতা দিয়ে জনসম্মুখে আনা বা সরকারী উদ্যোগে অনুরুপ একটি মার্কেটপ্লেস স্থাপন করে নবীন ফ্রীল্যান্সারদের সেখানে কাজ করার সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। আমরা জানি, সরকারের বিভিন্ন অফিসে প্রয়োজনীয় দক্ষ লোকবলের অভাবে ডাটা এন্ট্রি সহ নানা ধরণের কাজ পেন্ডিং পড়ে আছে কিংবা যে কাজগুলো পেন্ডিং নাই কিন্তু অফিসের বাইরের লোক দিয়ে যেমন বই ছাপানোর কাজ, জন্ম নিবন্ধনের কাজ ইত্যাদি কাজগুলো মার্কেটপ্লেস এর মাধ্যমে করিয়ে নিলে নবীনরা সহজে কাজ পেত এবং এই লোকাল মার্কেটে কাজ করে সে গ্লোবাল মার্কেটে কাজ করার সামর্থ্য অর্জন করতে পারতো। আমি যতদুর জানি, সরকারী অফিসের যেসকল কাজ নির্দিষ্ট মূল্য ধার্য করে বাইরে থেকে করিয়ে নেয়ার অনুমতি থাকে সেগুলো সংশ্লিষ্ট অফিস বাইরে থেকেই করিয়ে নেন কিন্তু মূল্য পরিশোধ করেন সরকারী ধার্যকৃত মূল্যের অর্ধেক বা তারও কম মানে বাকীটা তারা নিজেরাই পকেটস্থ করেন। অথচ কাজগুলো যদি মার্কেটপ্লেস এর মাধ্যমে করানো যেত, তাহলে কাজ প্রদানে যেমন নিরপেক্ষতা বজায় থাকতো, তেমনি কর্মীও কাজ করে ন্যায্য পারিশ্রমিক পেত, সেইসাথে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মানে এই উদ্যোগটি হতে পারে একটি মাইলফলক।

শেষ কথা বলবো, সুর আছে তাই গান গেয়ে যাই, কে শুনলো, আর কে শুনলো না তা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলবো তোমরা পড়বে না বরং তোমরা স্ট্যাডি করবে মানে কেবলমাত্র সনদপত্রের জন্য নয় জ্ঞানের জন্য অধ্যায়ন করবে। প্রযুক্তি তোমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তোমাদের দ্বারাই নির্মিত হবে প্রকৃতপক্ষে সুন্দর একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ, খুব শীঘ্রই বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আজকের এই বাংলাদেশ।
মোঃ আব্দুল হাই খান
পরিচালক
গাইবান্ধা কম্পিউটার এন্ড আইটি এডুকেশন
গাইবান্ধা সদর, গাইবান্ধা।
E-mail: haikhan2002@gmail.com